|
Contributors:
Poets and Translators:
Stanley H. Barkan Dariusz Tomasz Lebioda Sultan Catto
Catherine Fletcher Naznin Seamon David Lawton
Bishnupada Ray Ellen Lytle Richard Jeffry Newman
Roni Adhikari Dhanonjoy C Saha
Howard Pflanzer Maki Starfield
Natasha R Clarke Amirah Al Wassif
John Smelcer Ekok Soubir Hassanal Abdullah
A Tribute To
Buddhadeva Bose (1908-1974)
Poetry in Bengali
Hadiul Islam Suman Dhara Sharma Mahbub Mitra
Mohammad Jasim
Letters to the Editor
Naoshi Koriyama Carolyne Wright Sultan Catto
Peter Thabit Jones Samantha Jane Denise Moyo
Chandan Das Partha Banerjee Sulekha Sarkar Somnath Ray
Cover Art:
Thaira Almayahy Husen
New Logo:
Najib Tareque
|
|
Celebrating 21 Years of Publication
প্রকাশনার একুশ বছর
সম্পাদকের জার্নাল/Editor's Journal
১. কবিতার কথা
আমি যখন কবিতা লিখি তখন শব্দের পরে শব্দ শুধু ওজন মেপেই বসাই না, কবিতাটির দাড়ি কমা সেমিকোলন হাইপেন এমড্যাস সব কিছুই রচনা করি; লিখি উপমা অনুপ্রাস চিত্রকল্প, ছন্দ এবং বানান। ফলত, এর কোনোটিইকে কবিতা থেকে আলাদা করা যায় না। মানব দেশের যেমন প্রত্যেকটি প্রত্যঙ্গই সমান ভাবে কাজে লাগে, একটিও বাদ দিয়ে দেহটিকে পূর্ণ করা যায় না, আমার কবিতার ব্যাপারেও তাই। কোনোটিকে বাদ বা নতুন করে সাজানো যাবে না; হ্যাঁ, যদি সম্পাদনা করতে হয়, তবে সেটা আমাকেই করতে হবে। কারণ ওই কবিতার পুরোটা শরীর আমিই বুঝি, আর কেউ নয়। অন্যরা তাদের মতো করে বোঝেন, আমার মতো নয়। শব্দের ক্ষেত্রে যেমন আমি ‘ভালবাসা’ লিখি, ‘ভালোবাসা’ নয়। কারণ, ভালো থেকে আমি ‘ভালবাসা’কে দেখি না। আমি দু’টি মনের মিল বা মিলন থেকে কিম্বা বস্তু বা সমষ্টির প্রতি আমার আন্তরিক আবেগ দিয়ে যে সম্মোহনী টান অনুভব করি সেটি ‘ভালবাসা’—সে অবশ্যই ‘ভালো’ বানান থেকে পৃথক। তার আলাদা সত্তা রয়েছে।
২. নিরুদ্দেশ যাত্র
ক.
তেইশ বছরের যুবক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ইতিমধ্যে ছাত্র- রাজনীতি ছেড়ে পুরোপুরি যুক্ত হয়েছেন শিশু সাহিত্য রচনায়। ঢাকার দৈনিকগুলোতে নিয়মিত ছড়া ছাপা হচ্ছে। এমনকি সপ্তাহের সাতদিনই কোনো না কোনো দৈনিকে তার লেখা আসছে। লিখে ফেলেছেন বেশ কয়েকটি গল্পও। ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ নামে প্রতি সপ্তাহে এক দৈনিকে কলাম লেখা শুরু করেছেন। শহরের নিয়মিত শিশুসাহিত্য আড্ডায় পঠিত লেখার উপর আলোচনা করে কোনো কোনো লেখকের বিরাগভাজনও হয়ে উঠেছেন। রেডিওতে দুই কিস্তিতে ৫০টি গান জমা দিয়ে বিফল হয়েছেন, কিন্তু হাল ছাড়েননি। ঠিক এমন সময় তিনি উড়াল দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের দিকে। না, উন্নত জীবনের জন্যে নয়, বেঁচে থাকার তাগিদে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানিতে। প্রথমে বেকারি শপ ও কাপড়ের দোকানে কাজ করলেও, একবছরের মধ্যে ভর্তি হলেন সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের হান্টার কলেজে, সাথে সাথে কাজও পেয়ে গেলেন নিচের কোর্চের ছাত্রদের মেন্টর হিসেবে। এর মধ্যে শনি-রবি ট্যাক্সি চালিয়ে নিজের ও দেশে ছোটো বোনের একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর খরচ চালানো, মাকে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসা সবই চললো। পেলেন কিউনি পাইপ লাইন স্ক্যলারশিপ। বেচেলর ডিগ্রী শেষে আইবিএমএ চাকরির হাতছানি উপেক্ষা করে লেকচারার হিসেবে ঢুকলেন লাগুয়ার্ডিয়া কমিউনিটি কলেজে। এক বছরের মধ্যে কলেজের চাকরি ছেড়ে হাইস্কুল সিস্টেমে গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। আইবিএমের চাকরি উপেক্ষা করলেন কারণ তিনি জানেন লেখালেখিতে যুক্ত থাকতে হলে বইয়ের সঙ্গে থাকাটা জরুরি। ফলত, কবিতা ও সাহিত্যের অন্যান্য শাখা দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই তার জীবনের অংশ হয়ে উঠলো। সেই যুবকের বয়স এখন পঞ্চাশ। ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ নিউইয়র্ক বাসের ২৭ বছর পূর্ণ হলো। তিনি এ-ও জানেন এতে কারোই কিছু যায় আসে না, কিন্তু জীবন-বাস্তবতার এই ২৭টি বছর যুবকের জন্যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
খ.
গত বছর এই দিনে আমি আপনাদের ২৩ বছরের এক যুবকের গল্প বলেছিলাম যার বয়স এখন পঞ্চাশ পেরিয়েছে এবং ২৮ বছর আগে ১২ সেপ্টেম্বর যখন তিনি নিউইয়র্কের কুইন্স শহরে পাড়ি দিয়েছিলেন তখন এই গোলার্ধের মানুষ তো দূরে থাক একটি পাখিও চিনতেন না। যেখানে উঠেছিলেন, কদিন পরেই আবাসটি ছেড়ে তিনি ম্যানহাটনের ডাউনটাউনে এলেন স্টিটের একটি ম্যাসে স্থান্তরিত হন। দোতলার দুই রুমের একটিতে তিন খাটে তিনজন ও অন্য একটি ছোটো রুমে একজন ষাটোর্ধ ভদ্রলোক থাকতেন, যাকে সবাই ডাক্তার বলে সম্বোধন করতেন। সেখানেই তিনি প্রথম আমেরিকার মোটাতাজা ধাড়ি ইঁদুরের সাক্ষাত পেয়েছিলেন। রাতে পাইপ বেয়ে উঠে গৃহবাসীদের সন্ত্রস্ত করে রান্নাঘরে দৌড়ে বেড়াত। পরে অবশ্য আরো বিভিন্ন আকারের ইঁদুর প্রত্যক্ষ করার সুযোগ তার হয়েছে কিন্তু এমন স্বাস্থ্য সম্পন্ন সাহসীদের তিনি আর কখনো দেখেননি বললেই চলে, অতি সম্প্রতি আটলান্টিকের পাড়ে রকওয়ে সৈকতে রাতের নিন্মযামে পার্ক করে রাখা তার টয়োটা র্যাব ফোর গাড়ির নিচে ছাড়া। চারজনের সেই এপার্টমেন্টে তিনি আরো প্রত্যক্ষ করেছিলেন একটি অযাচিত মৃত্যু, যাকে সত্যিকারেই মেনে নেয়া যায় না, এবং যা বেঁচে থাকা তিন আবাসিকের মনে মারাত্মক কাঁপন ধরিয়ে যায়। ভদ্রলোক আদতে পাশ করা কোনো ডাক্তার ছিলেন না, ৭১-এ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের রনাঙ্গনে শুশ্রুষা করতে করতে একসময় তিনি অকুতোভয় দেশমাতার বীর সেনাদের কাছে ডাক্তার সাবে পরিণত হন। বিজয় দিবসের কদিন আগে তিনি দেশে যাবেন বলে ঠিক করেন এবং তদানুযায়ী কেনাকাটা করে তাঁর ছোট্ট ঘরটি ভরে ফেলেন। কী যে প্রফুল্ল হয়ে ওঠেন তিনি তা স্বচোক্ষে না দেখলে কেউ আঁচ করতে পারবেন না। সকালে তাঁর ফ্লাইট, রাতে যখন ঘরে ফিরলেন তখন অন্য তিনজন নৈশ ভোজরত। যদিও ডাক্তার আলাদা খেতেন, তথাপি তাঁকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে খেতে আহ্বান করলে তিনি রাতের খাবার সেরে এসেছেন জানিয়ে নিজের ঘরে ঢুকতেই অন্যরকম গোঙ্গনির শব্দ পেলেন তারা, এবং খাওয়া ফেলে যথারীতি দৌড়ে গিয়ে তাঁকে অচেতন অবস্থায় বিছানায় আবিষ্কার করলেন। মুখে একরাশ ফেনা। হাসপাতালে নেয়া হলো ঠিকই, কিন্তু বাসায় এম্বুলেন্স পৌঁছানোর আগেই ডাক্তার সাহেব পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। দেশে তিনি পৌঁছেছিলেন, তবে শহীদ কাদরীর মতো লাশ হয়ে।
এই মর্মান্তিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর যুবক আর ওখানে থাকলেন না। সোজা গিয়ে উঠলেন ব্র“কলিনের বোরো পার্ক নামক ইহুদী অধ্যুসিত এলাকায় সদ্য ভাড়া নেয়া এক বাঙালীর বাসায়। এই বাঙালী ট্যাক্সি চালাতেন, কিন্তু তার আত্মম্ভরিতা এতোই প্রখর ছিলো যে তিনি তার সামনে বাসার অন্যান্য ব্যাচেলার বর্ডারদের সোফায় বসতে দিতেন না। প্রথম দিনই অন্য দুই বর্ডার, যারা যুবকের প্রায় সমবয়সী, অকপটে জানিয়ে দিলেন যে ভুলেও যেনো যুবক এই কাজ না করে। তাদের ভাষায়, ওই ভদ্রলোক ছিলেন শিক্ষিত, আর শিক্ষিতদের সামনে অশিক্ষিতরা সোফায় বসতে পারে না, যদিও সুযোগ বুঝে ওই ট্যাক্সি চালক ভদ্রলোকই এই ভয়ংকর কাণ্ডজ্ঞানহীন বিদ্যা ওদের শিখিয়েছিলেন। একথা ঠিক যে অন্য যুবকদ্বয় দেশ থেকে একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ করে আসতে পারেনি, কিন্তু তারা কেউ অমানুষ ছিলন বলে যুবকের মনে হয়নি। ফলে একই বাসার একজন বর্ডার সোফায় বসলে অন্যরা কার্পেটে বসে তার কথা শুনবে, কিম্বা টিভি দেখবে, তা যুবক প্রথম দিন থেকেই মেনে নেননি এবং অন্য যুবকদেরও বুঝিয়েছেন এটা অন্যায়।....সেই যুবকতো আর কেউ ছেলো না, এই অধমই অনেক চড়াই উৎড়াই পার করে ২৮টি বছর কাটিয়ে দিলো এই শহরে।
৩. স্বতন্ত্র ধারা অনুসরণ করে নতুন সনেটের বই
১৯৯৫ সালের ২৯ এপ্রিল আমি প্রথম স্বতন্ত্র সনেটটি লিখি। সেই থেকে এই তেইশ বছরে আমি লিখেছি ২২০টি স্বতন্ত্র সনেট। [স্বতন্ত্র সনেট, তৃতীয় সংস্করণ, ধ্র“বপদ, ঢাকা, ২০১৩] এই ফর্মটি উদ্ভাবনের আগেও আমি বেশ কিছু সনেট লিখেছি, সেগুলো পেট্রার্কান ও শেক্সপীয়ারিয়ান ফর্মে, আবার কোনো কোনো সনেটে ফর্মও মানা হয়নি। তবে ‘স্বতন্ত্র সনেট’ লেখা শুরু করার পর এই ফর্মটিই আমি নিয়মিত অনুসরণ করেছি। বছর দশেক আগে ঢাকার এক তরুণ কবি, রবিউল মানিক, এই স্বতন্ত্র ধারায় বেশ কয়েকটি সনেট রচনা করে আমাকে চমকে দেয়। আমি আপ্লুত হই, তাঁকে উৎসাহ দেই। শব্দগুচ্ছ পত্রিকায় বেশ কয়েকটি প্রকাশও করি। এর পর হঠাৎ করে এক ব্রিটিশ কবির একটি ইমেল বার্তা পাই, যার নাম ক্যারোলিন গিল। তিনি বলেন যে ফেসবুক ও অন্যান্য মাধ্যমে তিনি আমার এই নতুন ধারার সনেটের কথা জানতে পেরেছেন, তিনি ধারাটি অনুসরণ করে সনেট লিখতে চান। আমি তাঁকে এই ধারার নানা দিক বর্ণনা করার পর তিনি সেটি অনুসরণ করে ইংরেজীতে সনেট রচনা করেন এবং একটি ব্রিটিশ পত্রিকায় আমার কথা উল্লেখপূর্বক প্রকাশও করেন। আমি পরে তাঁর সনেটও শব্দগুচ্ছ-এ ছাপি। এরই মাঝে আমার সুহৃদ, প্রতিবেশী, কবি আনিসুর রহমান অপুও এই ধারায় সনেট রচনা শুরু করেন। তিনি দ্রুত বেশ কিছু সনেট লিখে ফেলেন। শব্দগুচ্ছ তাঁর সনেটও ছাপতে থাকে। কিন্তু কেউ একজন সনেট দ্বারা আক্রান্ত হলে তার যে পাগলের মতো অবস্থা হয়, যেমন একদা আমারও হয়েছিলো, অপুর সেই অবস্থাটি বুঝতে পারি। তিনি দ্রুততম সময়ে একশ’র উপরে সনেট লেখেন। ওদিকে আমার এক ছাত্রী স্কুল শেষে আমার থেকে শিখে নিয়ে স্বতন্ত্র ধারায় সনেট লেখা শুরু করে। কিন্তু অপুর সনেট সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায় এবং তিনি একজন প্রকাশকও পেয়ে যান। এই প্রকাশক আর কেউ নন, বাংলা বাজারের ধ্র“বপদ প্রকাশনীর আবুল বাশার ফিরোজ, যিনি আমার ‘স্বতন্ত্র সনেট’ গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণটি প্রকাশ করেছিলেন। আমার প্রবর্তিত এই স্বতন্ত্র ধারায় এ বছর (২০১৮) বইমেলায় অপুর একটি বইও বেরিয়ে গেছে, যেখানে স্থান পেয়েছে ১১২টি স্বতন্ত্র সনেট। আনিসুর রহমান অপু বইটি আমাকে উৎসর্গ করেছেন। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। তাঁকে অভিনন্দন জানাই। আশা করি আজকের তরুণরাও এই ধারায় সনেট রচনা করবেন, এবং ইটালিয়ান ও ইংলিশ ধারার পাশাপাশি এই ধরারটিকে বাংলা সনেটের ধারা হিসেবে বিবেচনা করবেন। সাত-সাতে স্তবক বিন্যাসের পর অন্তমিলে থাকবে কখগঘকখগ ঙচছঘঙচছ; তার মানে প্রথম-পঞ্চম, দ্বিতীয়-ষষ্ঠ, ও তৃতীয়-সপ্তম, আর প্রথম স্তবকের চতুর্থ লাইনের মিল থাকবে দ্বিতীয় স্তবকের চতুর্থ লাইনের সাথে। ছন্দের ক্ষেত্রে অক্ষরবৃত্তের আঠারো (আট-দশ বা দশ-আট) মাত্রায় পর্ব গঠিত হবে।
৪. ‘মহাকাব্য’র অনুবাদ প্রসঙ্গে
কবিতা উৎসবে বা কাব্যপাঠের আসরে কতোজনের সাথেই তো পরিচয় হয়, কিন্তু কে কাকে মনে রাখে? এমন সব মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হয়, দু’তিন দিন তাদের সাথে এতো ভালো কাটে যে মনে হয় সারা জীবনের জন্যে বন্ধু হয়ে গেলাম। কিন্তু দু’চার দিন পরে সব আবার আগের মতো হয়ে যায়। সবাই-ই চলে যান আগের সেই অপরিচিত গণ্ডির মধ্যে। কিন্তু এবছর এক ব্যতিক্রমি ঘটনা ঘটলো। মে মাসে বস্টনের অদূরে সেলেম শহরে ম্যাসাচুসেটস কবিতা উৎসব থেকে ফেরার কয়েক দিনের মধ্যেই একটা ইমেল পেলাম। শিরোনাম, আমি সেই হাসানআলকে খুঁজছি যিনি অন্যরকম সনেট লিখেছেন। চিঠিতে তিনি জানতে চান আমার লেখা মানুষ ও মহাবিশ্বের খুঁটিনাটি নিয়ে মহাকাব্যিক গ্রন্থ [নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ (অনন্যা, ২য় সংস্করণ ২০১৭)] অনুবাদ হলো কি না। উত্তরে তাঁকে যতোই বুঝাই যে এই গ্রন্থের অনুবাদ এতো তাড়াতাড়ি হবার নয়, যে বই আমি বারোটি বছর ধরে লিখেছি তার অনুবাদ তো এতো সহজে দু’এক বছরে হবে না। তাছাড়া কোথায় পাবো আমি সেই অনুবাদক, যিনি আমার মতো একজন 'অচেনা' কবির এতোবড়ো বই অনুবাদ করতে রাজি হয়ে যাবেন! তদুপরি, এই কাজ তো যে কেউ করতেও পারবেন না! ক্লিন্টন বি সিলি, ক্যারোলিন রাইট, জ্যোতির্ময় দত্ত, কায়সার হক এঁরা কেউ চাইলে হয়তো কাজটি হবে। কিন্তু কেনো তাঁরা তা চাইতে যাবেন? যদিও জ্যোতির্ময় দত্ত, বইয়ের ২৬০টি এপিসোডের তিনটি একবার অনুবাদ করেছিলেন, এবং এই মুহূর্তে তিনি আমার ছোটো ছোটো কিছু কবিতা অনুবাদও করে দিচ্ছেন, কিন্তু তাঁর যে শারীরিক অবস্থা, তাতে তাঁকে আমি এই বই অনুবাদ করতে বলতে পারি না। ওদিকে গত সপ্তাহে আমার এই নতুন মার্কিনী বান্ধবির আরেকটি চিঠি পেলাম, আবারো জানতে চেয়েছেন বইটির অনুবাদ হলো কি না। তিনি পড়বেন বলে পণ করে বসে আছেন। আমি তাঁকে আবারও বিনয়ের সাথে জানালাম, অদূর ভবিষ্যতে কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। কিন্তু আজ আমাকে তিনি অবাক করে দিয়ে লিখেছেন যে বস্টনে তাঁর বাড়ির পাশে একঘর বাঙালি থাকেন। আমি চাইলে তিনি তাদের সাথে কথা বলতে পারেন। তাঁর ভাষায়, কাকতালীয় এই যোগাযোগ হয়তো একটি ভালো ফল এনে দিতে পারে। হায়, আমি কি করে তাঁকে বোঝাই, কবিতার অনুবাদ ওভাবে হয় না। যে কেউ তা করতেও পারেন না।
৫. দু’টি কবিতার অনুবাদ
এই [সেপ্টেম্বর, ২০১৮] সপ্তাহান্তে আমি দু’টি কবিতা অনুবাদের জন্যে দুশ’ মাইল গাড়ি চালালাম। আর এক রাতের অতিথি হলাম জ্যোতিদা ও মীনাক্ষীদির। সম্প্রতি মীনাক্ষীদির ছোটো বোন দয়মন্তি বসুর মৃত্যুতেও শোক-সমবেদনা জানানোর জন্যে গিয়েছিলাম বর্ষিয়ান এই দম্পতির বাড়ি নিউজার্সির অন্যপ্রান্তে প্রায় পেনসিলভেনিয়ার কাছাকাছি চেরি হিলে। বলা বাহুল্য, জ্যোতির্ময় দত্তের অনুবাদ খুবই উঁচু মানের। তবে ইদানীয় তাঁর চোখে অসুবিধা হওয়ায় আমি কবিতা পড়ে শোনানোর পর তিনি অনুবাদ করছিলেন, এবং আমি তা আমার ল্যাপটপে তুলে নিচ্ছিলাম। একেকটা লাইন বার বার পড়া এবং তার ইংরেজী খুঁজে বের করা যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার তো বটেই। তাছাড়া, এই বিশিষ্ট লেখক দম্পতির সাথে আড্ডা দেয়া মানেও অনেকখানি সাহিত্যিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়া। মাঝে আমাদের আড্ডায় একঝলক যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের পুত্রবধু কেসাং দত্ত ও একজন মার্কিনি প্রতিবেশী। দু’টি অনুবাদ ও অনেক মজার মজার অভিজ্ঞতা সাথে নিয়ে ফেরার সময় দুই ঘণ্টার পথ ট্রাফিক জ্যামের কারণে চার ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে, হোটেল হিল্টনের সামনে বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রীর জন্যে উৎসুক প্রবাসীর ভিড় ও ৫৮ স্ট্রিটে ট্রাম্প টাওয়ারের সামনে নিরাপত্তা জনিত কারণে রাস্তা বন্ধ দেখে সন্ধ্যায় বাড়ি পৌঁছলাম। কাল থেকে আবার কর্মজীবন।
৬. মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থশালায় বাংলা বই
আমার তিনখানা দ্বিভাষিক কাব্যগ্রন্থ এবং অনূদিত বই দেড়শ’র উপরে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, ইয়েল ইউনিভার্সিটি, ব্রাউন ইউনিভার্সিটির, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, কর্নেল ইউনিভার্সিটিও রয়েছে। আছে লাইব্রেরি অব কংগ্রেজের সংগ্রহেও, যেখানে আমার প্রকাশিত বইগুলোর উপর একটি ইলেকট্রনিক ফাইলও সংরক্ষিত আছে বলে জানা গেলো। ‘ব্রেথ অব বেঙ্গল’ (২০০০), ‘আন্ডার দ্যা থিন লেয়ারস অব লাইট’ (২০১৫) ও ‘স্বতন্ত্র সনেট: বেঙ্গালি উইথ ইংলিশ ট্রানস্লেশন বাই দ্য অথর, (২০১৭)—এই বইগুলো প্রকাশের পর থেকেই অ্যামজন ডট কম, স্মলপ্রেস ডিসট্রিবিউশনসহ বেশ কিছু সাইটে পাওয়া যায়। উল্লিখিত তিনটি গ্রন্থই প্রকাশ করেছে ক্রস-কালচারাল কমিউনিকেশন্স, শেষ গ্রন্থটি যৌথভাবে ফেরল প্রেসের সাথে। আমার অনূদিত গ্রন্থগুলো হলো কবি ও বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদের ‘সিলেকটেড পোয়েম্স’ (বিভাস ২০১৪, ঢাকা) ও কবি নাজনীন সীমনের কবিতার বই ‘হলোনেস অন দ্য হরাইজন' (ফেরল প্রেস ২০১৬, নিউইয়র্ক), ৩২জন বাংলাদেশের কবিকে নিয়ে আয়োজন ‘পোয়টস অব বাংলাদেশ’ (২০০৮)। অন্যদিকে, ইংরেজী, ফরাসি, পোলিশ, চাইনিজ, স্প্যানিশ, কোরিয়ান, ভিয়েৎনামি ও গ্রিক মোট আটটি ভাষায় আমার কবিতা যাঁরা অনুবাদ করেছেন তাঁরা হলেন জ্যোতির্ময় দত্ত, নজরুল ইসলাম নাজ, পূর্ণিমা রায়, ধনঞ্জয় সাহা, সিদ্দীক এম রহমান, টমাস সবুরেজ, রেচল রে, কুয়াংহুয়া রে, ডেনিস মেয়ার, মারিয়া মিস্ট্রিয়টি, শিলা আলসুলার, ও একক সৌবীর প্রমুখ। তাছাড়া এ পর্যন্ত ছয়টি বিশ্ব কবিতার অন্থোলজিতে আমার কবিতা স্থান পেয়েছে।
৭. মহাপ্রস্থান
পরপর দু'দিনে আমরা দু'জন বড়ো মাপের লেখককে হারালাম। চলে গেলেন স্প্যানিশ ভাষার কবি, চিলির নিকানোর পাররা আর বাংলা ভাষার ঔপন্যাসিক, বাংলাদেশের শওকত আলী। নিকানোর পাররার বয়স হয়েছিলো ১০৩ বছর, অন্যদিকে শওকত আলী মারা গেলেন ৮২ বছর বয়সে। পাররার সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি, কিন্তু তাঁর কবিতার সাথে আমি পরিচিত বহু বছর ধরে। 'বিশ্বকবিতার কয়েক ছত্র' নামে আমার অনুবাদ গ্রন্থে রয়েছে তাঁর কবিতা। তাছাড়া এবছর মাওলা ব্রাদার্স থেকে আমার প্রকাশিতব্য অনুবাদগ্রন্থ 'বিশ্বকবিতা সংগ্রহ'-এ বিশ্বের বিশজন কবির মধ্যে তিনিও আছেন। অন্যদিকে শওকত আলীর সাথে আমার দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। একবার বাংলা একাডেমীতে মইনুল আহসান সাবের ভাই ও তিনি একসাথে বের হচ্ছিলেন, সাবের ভাই তখন ভোরের কাগজের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করতেন এবং আমার বেশ কিছু কবিতা ছেপেছিলেন সেখানে। কথায় কথায় সেদিন শওকত আলী বলেছিলেন, "তোমার কবিতা আমি পড়েছি। কারো কোনো কথায় কান না দিয়ে তোমার মতো করে তুমি লিখে যাও।" শওকত আলী নিজেও সারা জীবন তাঁর মতো করে লিখে গেছেন। কারো কথায় তিনিও কান করেননি। সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা দেশের তিনটি উপন্যাসের কথা বললে সেখানে তাঁর 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' অবশ্যই স্থান পাবে। এটিকে বিশ্বমাপের উপন্যাস বলে আমি মনে করি। যারা এখন উপন্যাসের নামে 'অপন্যাস' রচনা করেন, তাদের জন্যে শওকত আলী কিছু দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাঁর কবরের পাশে বসে ওইসব অপন্যাসিকেরা হয়তো ভাষাটাও শিখে নিতে পারবেন। অন্যদিকে নিকানোর পাররার খ্যাতি ছিলো বিশ্বজোড়া, তিনি একজন কিংবদন্তি পুরুষ। কবিতাকে তিনি বলতেন এন্ডি পেয়েট্রি বা প্রতি কবিতা। তিনি কবিতায় সরাসরি কথা বলার একটি ধারা তৈরি করেছিলেন, এবং যারপরনাই সফল হয়েছিলেন। তিনি তরুণদেরকে প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে আঙ্গিক ভাঙার কথা বলতেন। জানা যায়, তিনি একাধিকবার নোবেল পুরস্কারের জন্যে নমিনেশন পেয়েছিলেন। আমি নিকানোর পাররার কবিতা অনুবাদ করার সুযোগ পেলেও শওকত আলীর জন্যে কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু ক'বছর আগে কোনো এক পুরস্কার কমিটির সম্মানিত একজন বিচারক আমার কাছে আজীবন সম্মাননা দেয়া যায় এমন লেখকের নাম জানতে চাইলে আমি তিনজনের নাম উল্লেখ পূর্বক বলেছিলাম, "নানা দিক বিবেচনা করে শওকত আলীকেই এবছর পুরস্কারটা দেয়া উচিত।" ভাবতে ভালো লাগছে সেবছর তিনি ওই পুরস্কারটি পেয়েছিলেন।...এই দুইজন মহান লেখকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
৮. অনুবাদকর্মের স্বীকৃতি
ইয়েল ক্লাবের ১৭ তলা থেকে কবিতাপাঠ শেষে নেমে এসে ট্রেনের দিকে পা বাড়াতেই দেখা হলো আরেক কবির সাথে যিনি অপেক্ষা করছিলেন ট্যাক্সির জন্যে। আমি হাত নেড়ে পুনর্বার বিদায় জানাতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার জন্ম কি এদেশেই?” আমি কৌতূহলী হয়ে থমকে দাঁড়ালাম, কারণ ২৭ বছরের মার্কিনী জীবনে অন্য অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হলেও এই প্রশ্নটি ছিলো একেবারে নতুন। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, “কেনো বলুন তো?” তিনি বললেন, “এতো চমৎকার অনুবাদ এখানে জন্ম না নিলে করা সম্ভব নয়! তাছাড়া কি চমৎকার পড়লেন আপনি!” কোরিয়ান এই কবির কথায় আমি শহর কাঁপানো অট্টহাসি দিয়ে বললাম, “আপনার এই মন্তব্যকে আমি গ্রেট কম্পিমেন্ট হিসেবে গ্রহণ করলাম।” সাথে সাথে মনে পড়লো ক’দিন আগে এক বাঙালী ফেসবুকে আমাকে ভর্ৎসনা করছেন এই বলে যে হাসানআল একজন মূর্খ, ইংরেজি লিখতে জানে না।
৯. সম্ভাবনার হাত-পা
আজ একটি মজার খবর এলো। আমার মার্কিন প্রকাশক, কবি স্ট্যানলি এইচ বারকান ইমেলে জানালেন যে একটি পুরস্কার কমিটি থেকে আমার বই ‘স্বতন্ত্র সনেট’ চেয়ে পাঠানো হয়েছে। পুরস্কারটির নাম বেস্ট ট্রানস্লেশন এওয়ার্ড। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট পুরস্কার কমিটির সভাপতি তাঁকে লিখেছেন, “আপনি গত বছর একটি বই প্রকাশ করেছেন নাম, স্বতন্ত্র সনেট। আমরা আশা করেছিলাম এ বছর বিবেচনার জন্যে আপনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বইটি পাঠাবেন। ৩১ ডিসেম্বর ছিলো বই পাঠানোর শেষ তারিখ। তবে আপনি যদি এখনও বইটি পাঠান, আমরা বাধিত হবো।” পুরস্কারের অর্থ মূল্য ১০ হাজার ডলার। এবং অধিকাংশ পুরস্কারের জন্যেই কিছু না কিছু এন্ট্রি ফি দিতে হয় বলে জানি, কিন্তু এই পুরস্কারের ক্ষেত্রে তাও নেই। এই পুরস্কারটি আমি পাবো কি না সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু কমিটি যে আমার প্রকাশকের কাছে বইটি চেয়েছে সেটিই আমার জন্যে বড়ো পুরস্কার। বাংলা ভাষায় এই ঘটনা সাধারণত বিরল। ‘স্বতন্ত্র সনেট’ আমি বাংলায় লিখেছি, এবং এই বইয়ের তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা থেকে। আমি প্রতিবছর ফেব্র“য়ারির বইমেলায় ঢাকাতে যাই, এবং এ-ও জানি যে মেলা মঞ্চে শত শত বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই সনেট সম্পর্কে বলতে আমাকে কখনো ডাকা হবে বলে কর্তা ব্যক্তিরা স্বপ্নেও কল্পনা করেননি; কারণ আমি কোনোদিন কাউকে তোষামোদ করি না। তাছাড়া, ‘কবিতার ছন্দ’ নামে আজ থেকে ২১ বছর আগে এই একাডেমিই আমার বই প্রকাশ করেছে। এ বছর সেই বইয়ের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করছে মাওলা ব্রাদার্স। সেদিন রাজেন্দ্র কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল নিউইয়র্কে তাঁর বক্তব্যে জানালেন যে তিনি তাঁর ক্লাসে আমার এই বই পড়িয়েছেন। এবং আমি জানি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বই ব্যবহার করা হয়। এমনকি আমি রকমারি ডট কমে দেখেছি যে প্রয়োজনীয় বইয়ের তালিকায় এই বইটি এক নম্বরে রাখা হয়েছে। কিন্তু মেলা মঞ্চ থেকে আজ পর্যন্ত ছন্দ নিয়ে কোনো আলোচনায় আমাকে যুক্ত করা হয়নি। না, বন্ধুরা, আমি কোনো পুরস্কারের কথা বা মঞ্চে ওঠার স্বপ্নিল ইচ্ছার কথা বলছি না। আমি আমাদের সামগ্রিক অধঃপতনের কথা বলছি। ‘স্বতন্ত্র সনেট’ যে ভাষায় অনূদিত হলো সেই ভাষার একটি সংস্থার পুরস্কার কমিটি বইটি চেয়ে নেয়; সেই ভাষার একটি বৃহৎ কবিতা উৎসব (ম্যাসাচুসেটস পোয়েট্রি ফেস্টিভল, ২০১৭) এই সনেট নিয়ে এর রচয়িতাকে সেমিনার পরিচালনায় ডাকে। কারণ, পৃথিবীর কোথাও কোথাও এখনো তোষামোদ ও পা-চাটার বাইরেও স্বাভাবিক সৃষ্টিশীলতা গুরুত্ব পায়।
[তথ্যসূত্র: বিশ্ব ক্যাটালগ ও ফেসবুক]
—হাসানআল আব্দুল্লাহ
Find us on Facebook
|
|
Printed Version
পত্রিকার মুদ্রিত কপি
Contents:
A Tribute to Buddhadeva Bose
Poetry in Translation (polish)
Poetry in Translation (Bengali)
Poetry in Translation (Ahtna)
Poetry in English 1
Poetry in English 2
Poetry in Bengali
Editor's Journal
Shabda News
Letters to the Editor
শব্দগুচ্ছর এই সংখ্যাটির মুদ্রিত সংস্করণ ডাকযোগে পেতে হলে
অনুগ্রহপূর্বক নিচে ক্লিক করে ওয়ার্ডার করুন।
To order for the hardcopy of this issue, please
click on the following link:
Get a Hardcopy
|
|