Rezanur Rahman Reza


Selected Poems of Hassanal Abdullah হাসানআল আব্দুল্লাহ'র নির্বাচিত কবিতা

Collected Poems by Baitullah Quaderee বায়তুল্লাহ্ কাদেরী'র কাব্যসমগ্র





Back to Issue 47_48
Back to Front Page
Shabdaguchha: Logo
Issue 47/48 : January - June 2010 : Volume 12 No 3/4



    রেজানুর রহমান রেজা

    হাসানআল আব্দুল্লাহ’র নির্বাচিত কবিতা: সামগ্রিকতার স্পর্শে স্পর্ধিত পংক্তিমালা

    কবিতার স্বর্ণলতা যে পৃথিবীর প্রতুলতা পেরিয়ে মহাকাশ, সৌরজগত ও নক্ষত্রমণ্ডলের স্বর্ণবলয় স্পর্শ করতে পারে তার প্রকৃত প্রতীতি জন্মায় হাসানআল আব্দুল্লাহ’র কবিতা পড়ে। কবিতা মনের কথাগুলো সুরে বলে। সে সুর হতে পারে ছন্দময়, হতে পারে বৈশাখের বাতাসের মতো অবাধ ও খেয়ালি।
    কথা বলার সময় আমাদের শব্দ ব্যবহার ও স্বর দুপুরের রোদের মতো—সাদামাটা। কিন্তু কবিতায় থাকে মেঘের ছায়া, বিদ্যুৎ ও বৃষ্টির ব্যঞ্জনা। হাসানআল আব্দুল্লাহ’র নির্বাচিত কবিতা এরকম অজস্র ব্যঞ্জনায় বাঙময়। তাঁর কবিতার ক্রম-পুষ্টি সম্পর্কে তিনি বলেন, “কখনো দ্রুত কখনো ঢিমে তেতালা তালে কখনো উৎফুল্ল কখনো বিষণœ কখনো জীবন্ত কখনো নির্জীব বেড়ে উঠেছে আমার কবিতা; নিরন্তর যেখানে রয়েছে ছন্দে শব্দে বাক্যে বুননে নতুনকে ধরার আকাক্সক্ষা।”
    তাঁর কবিতায় গঠনের নতুনত্ব আছে, আছে বিস্তৃতির বৈভব।

    স্বতন্ত্র সনেট বাংলা ভাষায় নিরংকুশ স্বাতন্ত্রের দাবীদার। আর নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ-এ মানুষ গ্রহ আর তারারা জীবন্ত, সংশ্লিষ্ট,—বিরাটত্বের বলয়ে বলিষ্ঠ। এখানে তাঁর ‘মাংসপিণ্ডের আধারে তৈরী...প্রত্যঙ্গ হেলে দুলে ব্যাখ্যা করে/উচ্চারিত শব্দের মহিমা।’ ‘দুর্দান্ত রোদের থাবায় কোকিল/ডুকরে ডুকরে কাঁদে।’ ‘অত:পর সেই কোকিল প্রথমে মানুষ, এবং আস্তে আস্তে পাথর নক্ষত্র হয়ে যায়।’

    নক্ষত্রলোক থেকে খানিকটা ভূমিকা’র দরোজা আলতো খুলে তাঁর পংক্তিমালার আঙিনায় পা রাখা যাক। একবিংশ শতাব্দীর আগের ছত্রে ছত্রে ‘ইচ্ছার ডানা’ মেলে কবি কিছুটা হলেও উড়েছেন শৈশবের দিনগুলোয়। যদিও:

    এমন গানের
    কলি বিড়বিড় করে কখনও করিনি উচ্চারণ
    যাতে ষোড়শীর ভেজা চুলের বিবিধ বন
    থেকে টপটপ ঝরে পড়া ফোঁটা ফোঁটা
    সলাজ পানির গন্ধ ছন্দাকারে বাতাসে বেড়ায় ভেসে।

    তারপরও ‘শালিক ধরার ফন্দি’ ঠিকই করেছেন।‘ভয়ংকর হতাশার জঘন্য উদরে’ চলে গেলেও ‘পায়রার ডাকে ঘুম ভাঙতো’ যা ‘মধুমতি নদীর মতন/ উজ্জ্বল ঢেউয়ে সারাক্ষণ’ ‘মৃদুমন্দ হাসি’তে ভরিয়ে রাখতো। তবুও তার ‘সহজ জীবন’-এ এসেছে ‘সময়ের হাহাকার’। চেয়েছেন:

    রাতের আঁধার যাক চলে যাক
    যাক না চলে দিনের কাক,
    পেটের ক্ষুধায় রসের হাড়ি
    অভিশাপের বিদায় ঢাক।

    এর মধ্যে ‘সোমত্ত চাঁদের দিকে তাকিয়ে’ ‘হৃদয় বাগানের আলো’য় কাছাকাছি এলেন ‘স্বাধীনতা’র। ‘নিরিবিলি পান’ করতে পারলেন ‘কবিতার রস’। ‘গোলাপকে গোলাপ বলার/অধিকার’ অর্জন করলেন। নামও দিলেন গোলাপের নাম তুমি:

    কোথায় রয়েছে কতোদূর কোন গাঁয়,
    বনানী,পাহাড়, নগর, বধ্যভূমি!
    এ মন ছুটেছে সেখানে ঝঞ্ঝা বেগে,
    গোলাপ, গোলাপ, গোলাপের নাম তুমি।

    শকুনেরা ভালো আছে কাব্যগ্রন্থে এসে কবি আরও সাহসী, প্রত্যয়ী, প্রতিবাদী। ‘ছিনা টান করে’ বলার সাহস অর্জন করেছেন। কারণ তিনি ‘রাষ্ট্রপালিত নাদুস/পশুদের কাতারের কেউ’ নন। তিনি ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, চকচকে রাইফেলের বীভৎস/ নলের সামনে শিরদাঁড়া টান করে/ যিনি করেছিলেন সুদৃঢ় উচ্চারণ, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ এই দুর্লভ, কষ্টাকীর্ণ স্বাধীনতার পরও রয়ে গেছে ‘মেঘাচ্ছন্ন আকাশ,’ ‘অনেক শকুন’। যারা:

    খায়দায় ঘোরে ফেরে আমাদের সাথে[;]
    হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ বিদগ্ধ শকুন
    তরতাজা মোটা মোটা উজ্জ্বল শকুন

    ...
    তুলে নেয় অর্জিত সভ্যতা
    ওদের ধারলো ঠোঁটে।

    তবুও আফসোস:

    রাজপ্রাসাদে যে যায় সে-ই স্বৈরাচার,

    ...
    সন্ধ্যা সকাল শিক্ষালয়ে রক্ত যায়

    ...
    দেশ তো স্বাধীন স্বাধীনতা আমরা চাই,
    শুয়োর কুকুর জানোয়ারের চামড়া চাই;

    মাস্তানে আর রাজনীতিকের সন্ধি নয়
    এবার দাবি, শত্র“ যেনো বন্দী হয়।

    সনেটগুচ্ছ ও অন্যান্য কবিতায় চেনা ভাব আর ভাষার প্রলম্ব প্রাঙ্গণে নতুনভাবে চলার পদধ্বনি আছে:

    তোমার গতর থেকে ছুটে আসা মিহিন আলোক
    আমাকে পাগল করে। স্পষ্ট বুঝে যাই, বেঁচে থাকা
    মানে হলো চাঁদ আর সবুজের মিলিত শোলক—
    এতোদিন এইসব মেঘের বার্নিশে ছিলো ঢাকা।

    স্বতন্ত্র সনেট-এর স্বাতন্ত্র বাংলা ভাষায় নতুন। গঠন আর আঙ্গিকের নতুনতা শুধু নয়, পংক্তিতে পংক্তিতে গাছের ছায়ার নীচে ঝিলের জলের স্বচ্ছতা, জলজ মৌনতা ও মিহিনতা টলটলায়মান। আছে প্রেম, প্রতিজ্ঞা, যৌনতা, ‘অবসন্ন সভ্যতা’র ‘অনাদায়ী কষ্ট।’ আলাদা করে না হয় একটি সনেট পড়েই নেয়া যাক:

    রাস্তার অজস্র মুখ তোমার সুবর্ণ মুখ বলে
    ভ্রম হয়। বরফের সমস্ত শরীর জুড়ে থাকে
    তোমার অশান্ত শরীরের দাহ। যেদিকে তাকাই
    স্বপ্নের মুকুল, আছে মুকুলিত ঘ্রাণ, আছো তুমি
    বুকের একান্ত কাছে হাসি খুশি নিজস্ব আদলে।
    আমার কবিতাগুলো তোমার শাশ্বত ছবি আঁকে—
    সুদূর নিয়েছে এই হৃদয়ের মাঝখানে ঠাঁই।

    কথাছিলো একসাথে পার হবো সুখের সীমানা
    কথা ছিলো এক খাটে নাক ডেকে ঘুমাবো দু’জনে,
    মৌনতায় সরাবো জঞ্জাল, যদি এসে করে ভীড়
    পায়ে পায়ে, চোখে মুখে থাকে তার চতুর দুষ্টুমি।
    কথাগুলো পরিপাটি, শূন্য ঘর কথার বিছানা—
    জীবনের সুখ ঢেকে চলে গেছে দূরে সঙ্গোপনে।
    পৃথিবীর দু’প্রান্তে দু’জন তাই অপেক্ষা অধীর।
       (স্বতন্ত্র সনেট ৬৮)

    আঁধারের সমান বয়স-এ অনাদী অন্ধকার পেরিয়ে আলোর প্রত্যাশার উচ্চারণ মুগ্ধকর:

    পৃথিবীর পেট হলো, জন্ম নিলো একক আকাশ
    পৃথিবীর পেট হলো, জন্ম নিলো চাঁদ
    পৃথিবী আবারও গর্ভবতী, পুনরায় জন্ম যদি নেয়
    অজস্র আলোক
    স্নান সহসা করতে পারি
    সুতীব্র আনন্দে যথারীতি একঝাঁক আমরা মানুষ।
       (জন্ম নিয়ে কথা)

    নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ প্রচ্ছন্ন প্রস্তুতি নিয়ে পড়তে হয়। পৃথিবী থেকে আকাশযাত্রার এক সমূহ সম্ভাবনার প্রস্তুতি। কথা কল্পনা ভাব ভাষা ও আদলের সুদীর্ঘ ধারাক্রমের বিশালতায় ভেসে বেড়ানোর এক নিরন্তরতা যেনো। এখানে বোধ এবং বুঝে ওঠার দরোজা খোলে ধীরে ধীরে। সীমাহীন শূন্যতা, অসীমতার মধ্যেও এর চরিত্রগুলো জীবন্ত, একান্ত চেনা—পারিপার্শ্বিকের। যেখানে ‘গোলাপের মতো’ মেলে দেয়া যায় ‘অসংখ্য পাপড়ি মনের আনন্দে।/সুবাস দুরন্ত ঘোরে অক্সিজেনপূর্ণ/বাতাসে বাতাসে।’ যেখানে:

    ব্লাকহোল হয়ে বিলুপ্তির সম্ভাবনা নিয়ত তর্জনি তুলে বিপুল শাসায়

    আর সময়ের সাথে বিবর্তিত মহাবিশ্ব বাদানুবাদিক চেতনার অপসৃয়
    আনন্দে বিভোর বিগব্যাঙ্গ থেকে বিগক্রাঞ্চ, দীর্ঘ পরিক্রমার নকশা

    আঁকা সুবর্ণ সুষম সম্পন্ন শরীরে সমৃণ সম্প্রসারণে অগ্রসরমান...শিশু
    থেকে উচ্ছ্বল যৌবন, তারকাপুঞ্জের বহুরৈখিক বর্ণালী আলো ঝলমল
    অধ্যায় পেরিয়ে অদ্বৈত বিন্দুর দিকে হয়তোবা পুনরায় যাত্রা শুরু করে।
       (নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ: ৫ম সর্গ, ৫১ খ)

    এক পশলা সময়-এ হাসানের ‘একটি সিদ্ধান্ত’ চমৎকার:

    সব গ্রন্থই পবিত্র
     অতএব জিকির থামিয়ে বলো
      এতোকাল ক’খানা পড়েছো।

    সব ঘরই পবিত্র
     অতএব তাণ্ডব থামিয়ে বলো
      তুমি তার ক’খানা গড়েছো।

    ঈশ্বর মরে গেলে[!] তাঁর অবসর কাটবে আনন্দময়তায়:

    ঈশ্বর যখন মরে যাবে
    আমি নদীতে সাঁতার
    কাটবো, খেলবো ফুটবল
    আর ভক্ত খুঁজে আনবো অসংখ্য
    যারা মহানন্দে হাততালি দেবে।

    অতঃপর তিনি মানুষের পা ধরে বলবেন, ‘মুসা, ঈসা,/মোহাম্মদ ও কৃষ্ণকে নিয়ে আরেকবার ভাবতে/শতাব্দীর পর শতাব্দী যাদের জন্য [তারা] একে অন্যকে প্রকাশ্যে খুন করে চলেছেন।’ কারণ এসব সত্য নয়, ‘শূন্যই প্রকৃত সত্য আর সব কৃত্রিম, বানানো।’

    সময় সবার অন্তিমতা নিয়ে আসে। তবুও সময়ই সামলে নেয় তা। ‘আমার মৃত্যুর পর’ কবিতার ক’টা লাইন:

    আমার সন্তান আর নিকটাত্মীয়রা যার যার
    চোখ মুখ ধুয়ে
    ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় গোসল সেরে ফেলেছেন।

    ...
    এক অচেনা পরিবারের দুরন্ত একটি বাচ্চা
    দরজার পাশে পরিপাটি
    আমারই জুতোর ভেতর দুই-পা ঢুকিয়ে
    তার মাকে ডেকে সানন্দে বলছে, “দেখো, কী স্ন্দুর!”

    বরই গাছে চড়ুই নাচের ছড়াগুলো যেনো টিনের চালে বৃষ্টি, বিকেলের আলো:

    বরই গাছে চড়ুই নাচে
    খোকার হাতে ঢিল,
    ঝপাত করে পড়লো ডালে
    চৈত্র মাসের কিল।

    বরই প’লো, বরই প’লো
    চড়ুই দিলো ছুট,
    ভর দুপুরে পাকা বরই
    সবটা হলো লুট।

    বিশ্ব কবিতার কয়েক ছত্র হাসানের অনুবাদে সাবলীলতার প্রমাণ। বোদলেয়ার, ভিশোয়া সিমবোরস্কা, নিকানোর পাররা, স্ট্যানলি কিউনিটজ ও এডোনিস থেকে সুনতারো তানিকাওয়া’র উচ্চারণগুলো নির্মল নির্ঝরতায় তুলে এনেছেন বাংলায়:

    আমিও ঘুমাতে চাই। ঘুমাতে, বাঁচার জন্যে নয়।
    মৃত্যুর মতন এই সুদীর্ঘ ঘুমের মাঝে আমিও দেখতে চাই স্বপ্ন:
    দ্বিধাহীন প্রসারিত তোমার চুম্বনগুচ্ছ অকাতরে লেহন করছে
    আমার শরীর, সুমসৃণ সেইসব ভাঁজ থেকে তোমার উজ্জ্বল গন্ধ ছুটে আসে।
       (লিথি/বোদলেয়ার)

    হাসানআল আব্দুল্লাহ’র নির্বাচিত কবিতার দীর্ঘ পরিসর স্বল্পতায় স্পর্শ করা দুষ্কর; বিস্তর পাঠ প্রয়োজন। ১৯৯০ থেকে ২০১০, তাঁর বিশ বছরের কবিতার সুঠাম তারুণ্য খোলা মাঠের মতো অবারিত, নদীর মতো ধাবমান—দু’পাশের অজস্র কবিতার ফসল ঘরে তোলার সোনার তরীটি ভরে উঠছে অবিরাম।



    হাসানআল আব্দুল্লাহ, নির্বাচিত কবিতা, অনন্যা, ঢাকা, ২০১০: পৃষ্ঠা ২৭২, মূল্য ৩০০টাকা

Shabdaguchha, an International Bilingual Poetry Journal, edited by Hassanal Abdullah