Back to Issue 45_46
Back to Front Page
Shabdaguchha: Logo
Issue 45/46 : July - Dec 2009 : Volume 12 No 1/2



বাংলা কবিতা: শতাব্দী পরিক্রমা

শাহ্ ফজলে রাব্বী

কী অত্যাশ্চার্য ভাষায় কথা বলে রূপদক্ষ শব্দের কারিগর। কবিতা তো সেই হিরন্ময় হাতিয়ার যা মানব অন্তরকে দলিত, মথিত ও স্পন্দিত করে; সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমের পক্ষে যা সম্ভব নয়। বুদ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন, “বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের ইতিহাস কবিতার দ্বারা গদ্যরাজ্য জয়ের ইতিহাস।” আজ এই একবিংশ শতাব্দীতেও সম্ভবত এ কথার যথার্থতা অনস্বীকার্য। সাধারণ মানুষের জীবনে আধুনিক কিংবা উত্তরাধুনিক কবিতার বিশেষ কোন ভূমিকা আছে কিনা সে সম্পর্কে অতীতেও বিতর্ক ছিল আজও হয়তো আছে কিন্তু বর্তমান বিশ্ব বিপুলভাবে যান্ত্রিকতার দিকে এগিয়ে গেলেও কবিতাকে নির্বাসিত করা হয়নি। বস্তুতপক্ষে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ দেশগুলোতে নতুন নিরিখে নতুন আঙ্গিকে আবিষ্কার করে কবিতাকে প্রতিষ্ঠার কাজে উদ্যোগী হয়েছেন সেসব দেশের আধুনিক ও উত্তরাধুনিক কবিরা। বর্তমান কালের কবিতা বৈদগ্ধ প্রজ্ঞা ও আদিমতাকে ধারণ করে, ইচ্ছার ক্রমিকতায় এবং আনন্দের সংক্রমিকতায় খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করছে একটি অনির্বচনীয় উত্তরণের। বর্তমান কালের কবিতা মানবীয় ইচ্ছাকে অতিক্রম করে মানব স্বভাবের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে প্রকৃতির মত। বাংলাদেশের কবিতাও প্রবল পরাক্রান্ত এবং সুতীক্ষ্ণ ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
রবীন্দ্রত্তোর বাংলা কবিতা ত্রিশের বলিষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু এই পঞ্চপাণ্ডবের হাত ধরে প্রবিষ্ট হয় আধুনিক ও আন্তর্জাতিক বলয়ে। তাঁদের প্রজ্ঞা মেধা ও মননের ধার আধুনিক বাংলা কবিতাকে দিয়েছে এক অনিবার্য গতি।
তিরিশের সার্থক উত্তরাধিকার বহন করছেন পঞ্চাশের ক’জন উজ্জ্বলতম কবি। এঁদের মধ্যে রয়েছেন আহসান হাবীব [চল্লিশের দশক], শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এঁরা স্ব স্ব ভাবে কাব্যচর্চা করে আধুনিক বাংলা কাব্যকে অধিকতর শক্তিশালী করেছেন।
ষাটের দশক আমাদের মানসলোকের ক্রান্তিকাল। অস্থিরতা, নৈরাজ্য, নৈরাশ্য ও অবক্ষয়জনিত একটি দশক। এ দশকের কবিদের কবিতা পড়লে মনে হয় যেন কবিরা অমৃত ও গরল উভয়ই পান করেছেন। একদিকে যেমন তাঁরা উচ্চারণ করেছেন যন্ত্রণার প্রদাহ, অন্যদিকে ছিলেন নতুন শপথে দীপ্ত। পঞ্চাশের উজ্জ্বলতমদের উত্তরসূরী তাঁরা, তাই অনিবার্যভাবে মেধা ও মননের চর্চা পরিলক্ষিত হয় তাঁদের কবিকর্মে। নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষায়ও ব্যাপৃত ছিলেন তাঁরা। এ দশকের কবিদের কেউ কেউ বোদলেয়ারের স্মরণাপন্ন হন, কেউ আবার দুঃখবাদী কবি র‌্যাবোর আশ্রয় গ্রহণ করেন। প্রথাসিদ্ধ পথ না মাড়িয়ে ষাটের কবিরা উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প ও শব্দচয়নে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য আনার চেষ্টা চালান, যা আধুনিক বাংলা কবিতার ধারায় আরেকটি মাত্রা সংযোজন করে। তাঁরা তারুণ্যের যন্ত্রণা এবং সত্য জীবনবীক্ষা উপস্থাপন করে তারই রসে কবিতাকে সম্পৃক্ত করেন। এ দশকের যে সব কবি উজ্জ্বল সাক্ষর রেখেছেন তাঁদের মধ্যে রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ, সিকদার আমিনুল হক, আব্দুল মান্নান সৈয়দ এবং আবুল হাসান প্রধান।
সত্তর ও আশির দশকে আধুনিক বাংলা কবিতা ষাট দশকের ধারাবাহিকতা মেনে চলেনি। সত্তরের দশকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ছিল চূড়ান্ত ভাবে অরাজকতাপূর্ণ। তরুণদের হাতে ছিল কবিতার বইয়ের বদলে জমা না-দেয়া অস্ত্র। স্বাধীনতার উজ্জ্বল আভার বৈপরীত্যে সবার চোখে ছিল বিপন্ন বিস্ময়। মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সামাজিক অবক্ষয় ইত্যদি মিলে সত্তর ও আশির দশকের কবিতা সুস্থ রূপ পরিগ্রহণে সক্ষম হয়নি। এ-সময়ের কবিরা তাদের সমসাময়িক কালকে সঠিক শিল্পমানে সমৃদ্ধ করতে পারেননি। সীমাহীন শূন্যতাবোধ থেকেও মহৎ কাব্য উৎসারিত হতে পারে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তা হয়নি। একটি অস্থির সময়ে শিল্প-সাহিত্য নিজস্ব গতিতে চলে না। এ নিয়ম ভেঙে গতি আনার জন্য যে ধরনের শক্তিশালী কবির প্রয়োজন তা দেখা যায়নি এ দু’দশক জুড়ে, যদিও আশির দশকের কিছু কবি ষাটের কাব্যচেতনা লালনের চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের পাপাচারকে উসকিয়ে দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভে সচেষ্ট ছিলেন কেউ কেউ─আবার শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর ছিলেন অনেকে। এর মাঝেও আমাদের কবিতাকে উজ্জ্বল করেছেন অনুরাধা মহাপাত্র, আবিদ আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও আবু হাসান শাহরিয়ার।
নব্বই দশকের কবিরা কবিতাকে ভিন্ন পথগামী করার কাজে ব্রতী হন। এই স্থিতিশীল সময়ে তাঁরা বিদেশী মিডিয়া ও ইন্টারনেটের প্রতি আকৃষ্ট হন। বিশ্বকাব্য সাহিত্যের নবদিগন্ত উন্মোচিত হয় তাঁদের কাছে। তাঁরা অনেকেই উত্তরাধুনিকতাবাদে মনোযোগী হন।
সমকালীন চিন্তাজগতের এক মহাবিষ্ফোরণ এই উত্তরাধুনিকতাবাদ, বহু সমর্থিত এবং বহু নিন্দিত একটি অভিজ্ঞান রূপে দ্রুততর সময়ে এত প্রচারিত এবং সম্প্রসারিত হয়েছে যে এ নিয়ে তর্ক করা যায় কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাত্ত্বিকদের সাথে একমত হয়ে তাই বলা যায়, উত্তরাধুনিকতা একটি অতিশয় দুর্ভাগ্যজনক শব্দ। দুর্ভাগ্যজনক বলেই শব্দটিকে যত্রতত্র ব্যবহৃতও হতে দেখা যায়; অনেক ক্ষেত্রেই অন্তর্নিহিত তাৎপর্যমণ্ডিত দর্শন বিবেচনায় না এনে। উত্তরাধুনিকতা একটি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বা ব্যত্যয় যা অতীতে ফিরে স্পর্শ করতে পারে বাল্মীকিকে, অন্যদিকে স্পর্শ করতে পারে বিজ্ঞানের আবি®কৃত সর্বশেষ নক্ষত্রবলয়। তাত্ত্বিকেরা যেমন আধুনিকতাবাদের আলোকবর্তিকায় প্রবাহিত শতাব্দীর সনাতন ঐতিহ্য, জীর্ণ ও ধর্মীয় আচার অনুশাসন ও নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির প্রতি প্রশ্ন তোলেন, এ-সময়ের কবিরাও মূল্যবোধ থেকে যে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের জন্ম তার দ্বারা শাসিত না হয়ে নৈরাশ্যবাদী হয়ে ওঠেন। অতএব উত্তরাধুনিকতাবাদ মূলত আধুনিকবাদ এবং আলোকপ্রাপ্ত শতাব্দীর মিথ্যে আশাবাদ, নৈরাশ্য ও অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে একটি শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে নেতির সমর্থনে ইতিকে আনা জরুরী হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে উত্তরাধুনিক কাব্যচর্চা যথার্থ সাফল্যের দিকেই এগিয়েছে। এ সময়ের কবিরা মনন ও মেধায় বলিষ্ঠ। উত্তরাধুনিক কবিতা এবং প্রথাসিদ্ধ কবিতা সমার্থক নয়। এ কবিতা শিকড় সন্ধানী। কখনো অরণ্যজনপদে, চর্যাপদের আলো-আঁধারির জগতে, মধ্যযুগের গীতি কবিতায় আবার কখনো নক্ষত্রমণ্ডিত মহাকাশে আলোক সিঞ্চন করে এগিয়ে যান আমাদের উত্তরাধুনিক পর্বের কবিরা। স্বদেশের জল মাটি ও কাদার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে দেশজ উপমা উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পের পাশাপাশি ক্ল্যাসিকে সমর্থিত হয়ে ওঠেন এঁরা।

নব্বই দশকের এই উত্তরাধুনিক উজ্জ্বল কবিদের অন্যতম শব্দগুচ্ছ সম্পাদক হাসানআল আব্দুল্লাহ। তাঁর স্বতন্ত্র সনেট নামের সনেট সঙ্কলন ছন্দোপ্রকরণে ও চিত্রকল্প নির্মাণে স্বাতন্ত্র্যের ভাস্বর। আব্দুল্লাহর প্রকাশিত বৃহৎ কাব্যগ্রন্থ নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ উত্তরাধুনিকতার স্বীকিরণে ও বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ধ্রুপদী শব্দ চয়ন, সর্গ বিভাজন, ছন্দ ব্যবহার রীতি ইত্যাদির সংমিশ্রণে এ গ্রন্থটি মহাকাব্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ক্লাসিক ও মিথ উভয়ের দ্যোতনা রয়েছে এই কাব্যে। বায়তুল্লাহ কাদেরী ধ্র“পদী-সঞ্চারি একান্তব্যক্তিক, নৈঃসঙ্গ-সম্পৃক্ত কবি। রহমান হেনরীর কবিতা প্রায়শই জল-মাটির কাছাকাছি। উভয়েই চর্যাপদের প্রজ্ঞাময়তা, বৈষ্ণব কাব্যের অন্তর্নিহিত নির্যাস এবং মিথকে সংস্থাপিত করছেন তাঁদের কবিতায়। শব্দ-প্রয়োগ কৌশল এবং চিত্রকল্প নির্মাণে এঁরা ব্যতিক্রমী; এবং উল্লিখিত এই তিন কবিই শেকড়-সন্ধানী। টোকন ঠাকুর, আলফ্রেড খোকন, তুষার গায়েন, প্রবীর দাশ নব্বইয়ের উল্লেখযোগ্য কবি। পরিশীলিত ও পরিমার্জিত ভাবে এগিয়ে কবিতা লিখছেন শামীম রেজা, নাজনীন সীমন, ওবায়েদ আকাশ এবং রুকসানা রূপা। দৃঢ় আশাবাদের প্রত্যয় রয়েছে এঁদের প্রত্যেকের কবিতায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি। সঞ্চয়িতা প্রকাশ কালে তিনি বলেছিলেন, “I do not believe in any superlative degree," যদিও তিরিশের কবিরা তাঁকে কবিগুরু আখ্যায়িত করেছিলেন নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থানের জন্যে। রবীন্দ্র পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ। এখন সম্ভবত একথা বলা ঠিক হবে যে যুগ-ধর্মই নির্ণয় করে একজন কবি বা সাহিত্যিকের শ্রেষ্ঠত্ব। উত্তরাধুনিক কবিদেরও শেষ পর্যন্ত ওই কালের কাছে নত হতে হবে। নিরবধি কালই সাক্ষ্য বহন করে শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের।



Shabdaguchha, an International Bilingual Poetry Journal, edited by Hassanal Abdullah