|
Poetry in Bengali/বাংলা কবিতা
|
|
প্রবীর দাস
বিবিধ শোকের উপমায়
খোলা ছাদে চারদিক থেকে শিরশিরে হাওয়ার কাঁপন লাগলেই মনে পড়ে নদীর
কাছাকাছি গিয়েও তার জল না ছুঁয়ে ফিরে আসার কথা—চোখের কোণ থেকে
কপাল থেকে চিবুকে হৃদয়ে ভাসে শুধু চূর্ণ কষ্টের গুঁড়ো। একটু আগে যে
মোলায়েম বৃষ্টি আমাকে ডেকেছিল নানা উপাচারে তখন ভুল করে অন্য কোনো
অপরূপ মেঘবন্দনায় আকাশে তাকিয়ে ছিলাম মুহ্যমান আমি। তারপর যতই বৃষ্টি
খুঁজি কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া লেখে বৃষ্টির চলে যাওয়ার কথা...প্রতিটি বোধিবৃক্ষের
নীচে তপস্যারত আমার মতো যারা কেবলই দ্যাখে প্রবাহিত নদীর জল ক্রমশ
ভাসানের সময় কথাটা নির্মম হয়ে আমাকে মানস-প্রতিমাগুলি আরও নীচে যেতে
যেতে উপহার দিয়ে গেল কালো মেঘ বিবিধ শোকের উপমায় অজস্র জলপ্রপাত।
নির্জনতার নতুন তথ্য
অরণ্যের কথা ভাবছি। নির্জনতার কথা লিখতে চাইছি কিন্তু কেমন রঙের হতে
পারে অরণ্যের মধ্যস্থল! নির্জনতায় যে কোকিলধ্বনি এই আষাঢ়ের প্রথম ভাগে এ
তো বেমানান। বসন্ত কি যখন তখন কোকিলের নির্দেশ! অতএব গভীর গবেষণায়
ঢোকা যাক যেখান থেকে কেউ থিসিস জমা দেয়নি বরং কবিতাই সমস্ত
খোলনলচে বদলে মৃতপ্রাণকে জাগিয়ে অভয়ারণ্যে ছেড়ে দিতে পারে—রোবট না
হয়েই সে তুলে আনবে রং, কোকিলের পাশাপাশি আরও অনেক পাখির
কূজন...প্রতিবেশী গাছেদের মাথায় মাথায় একটি করে কবিতার শিরোনাম বসিয়ে
ক্লিক করতেই শিকড় ছাড়িয়ে অরণ্য থেকে বৃক্ষগুলি উঠতে উঠতে এমন
বেলাভূমিতে সেঁটে যাবে যেখান থেকে নির্জনতা বিষয়ক সমূহ তথ্য এসে সমৃদ্ধি
দেবে অঢেল।
শান্তিনিকেতন
মতিন রায়হান
ঘরবাড়ির কথা
ঘর বলে কিছু নেই, তবু ঘরের টানেই ঘুরেফিরে আসা...
প্রিয় বসতিকে টানে পাড়ভাঙা নদী, বৃষ্টিসূত্রে ইলিশের ঢেউ
কামড়ে ধরে তীর, মহান কৈবর্ত তবে মাছরাঙা পাখি!
এমনই জলের নিয়ম, জলে ও অনলে লেখা ধীবর-কাহিনী...
পাখিরাও ঘর বাঁধে, পাখিদেরও আছে পুত্র-কন্যা-জায়া
সন্ধ্যার আলোয় ভিজে ঘরে ফেরে পাখিকন্যা
পাখিপুত্র, সে-ও ফেরে ঘরে রাত কিছুটা গভীর হলে...
পাখিবংশে যত কথা যত অপসুর পাখিকন্যা নিয়ে
মানবকুলের ঢেউ আহা আজ পাখিঘরেও লাগে!
ঘর বলে কিছু নেই, যদি থাকে তবে সেটা ঘরের প্রতীক
আপাত ঘরের কথা নয়, কথা হোক ঘরবর্তী মানুষের...
কালের তরিকা
আমরা মূলত জ্যোৎস্নার নামে ফেরি করি অন্ধকারের ঢেউ
কালচে জ্যোৎস্নায় রোজ ঢেকে যাচ্ছে আমাদের বর্তমান
সুবর্ণ অতীত আজ দুর্গম গুহার যথার্থ উপমা
ধূর্ত শেয়ালের মতো লেজ তুলে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ভবিষ্যৎ
তিনটি গলি আজ মিলেমিশে চোখের পলকেই তেমাথা
আর ভরদুপুরে তেমাথায় ভেংচি কাটে পেতনীকুল
ভয়ে দৌড়ে পালায় শেয়াল-মানুষ...
আমরা মূলত জ্যোৎস্নার আগুনে রান্না করি গহীন অন্ধকার
প্রতিদিন চিত্রকল্পের বদলে রচনা করি অগণন কল্পচিত্র
রূপকথার রাখাল সেজে চেঁচাতে থাকি ‘বাঘ-বাঘ’
কাকের বাসায় ডিম পেড়ে গেয়ে উঠি ‘কুহু-কুহু’
আমরা আসলে কাকতাড়–য়ার বেশে প্রতিদিন জ্যোৎস্না তাড়াই!
ঢাকা
হাসান সাব্বির
স্বপ্ন দেখছি
মগ্ন হলে কবিতায় আত্মহননের ইচ্ছা মরে যায়--শূন্য থেকে শূন্যে এসে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে--নির্দিষ্ট দূরত্বে এসে নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছে করে, সুরভী...।
চোখের পাতায় স্বপ্ন থাকলে রোমান্টিক লাইফ--পা রাখি যখন পাথরের পথে তখনই টের পাই নদী ভাঙ্গনের মতো তীব্র ফাটল এক হা-করে চেয়ে থাকে যেন
ভীষণ ক্ষুধার্ত একচক্ষু দানব! বলি না দুর্বলচিত্ত--তবুও কোথায় যেন চোখে পড়ে ষড়যন্ত্রের নরক অন্ধকার।
পুলসিরাত পার হয়ে যাচ্ছে প্রত্যেকেই আর আমি কল্পনার রাজ্যে শয্যা পেতে স্বপ্ন দেখছি আকাশ-কুসুম। ঘুম ভাঙলেই চোখে পড়ে বৃশ্চিক আর পঙ্গপালে ভরে আছে দৃশ্যের দুপুর--চোখে পড়ে সর্বনাশের চূড়ান্ত।
রঙ হারানো জীবনের গল্পে
ইচ্ছেরা পোকা-মাকড় হয়ে হেঁটে যাচ্ছে...
আমি বসে থাকি স্থির। পলক না ফেলা চোখে দেখি কেমন করে সবুজ মুছে যাচ্ছে প্রকৃতির পাতা থেকে--ঋতুরা হঠাৎ এসে হঠাৎ হারিয়ে যাচ্ছে ছায়া হয়ে। এইসবের মধ্যে আমি মাসের পর মাস--বছরের
পর বছর স্থির বসে আছি--বসে থাকি।
ইচ্ছেরা সব পোকা-মাকড় হয়ে যাচ্ছে--যাক। নীল নেই--লাল নেই! ইচ্ছেহীন আমি বসে থাকি জলহীন নদীর পারে--রঙ হারানো জীবনের গল্পে, অনন্তকাল।
মাগুড়া
অরবিন্দু চক্রবর্তী
টেরাকোটা নিমাই পথে প্রত্নপরানেই ধাবমান
আমাকে বারবার বাসনা করে হতাশ হচ্ছে যে
তার জন্য আইটাই
উচ্ছ্বল আবেগে
নির্মাণ করছি শব্দপ্রাসাদ
আমি নির্বাণ বনসাই প্রকল্প বাজেটে
এঁকে যাচ্ছি টেরাকোটা
নিমাই পথ
যে পথজুড়ে বিরাগদ্যোতনে
ইতিহাসের পত্রালি ছুঁয়ে
চিত্রল হেঁটে এসেছেন বিনয়-তুকারাম
আমি এই নন্দিত সিঁড়ি বেয়ে
হাওয়াই সন্ন্যাস মেখে
ক্রমশ সোনার হরিণ ছুঁয়ে
সেই প্রত্নপরানেই ধাবমান।
সচিত্র ছায়ার নাচ
রোল তুলে হাসছো--নাগালের বাইরে--
পাতার আড়াল থেকে একটা জখম ক্রমশ
লাল হয়ে উঠছে অতঃপর ঝলসে যাবার মত বেগুনী
এসব সচিত্র ছায়া নেচে নেচে
দু'ফালি করে যাচ্ছে আশ্চর্য কল্লোলে
ফলে, আমি যেন ট্রাম দুর্ঘটনায় কাটা পড়ে আছি
এক উদ্বাস্তু, জনস্রোতে
যে হাসছো পারো না কি পতনের উচ্ছিষ্টাংশটুকু
মুঠোতে তুলে আরেকবার ভৈরবী নাচতে!
ফরিদপুর
নাজনীন সীমন
পুঞ্জ পুঞ্জ দীর্ঘশ্বাস
বুক থেকে উঠে আসা পুঞ্জ পুঞ্জ দীর্ঘশ্বাস
চরাচর ভাসায় নির্মোহ সন্ধ্যায়, অথবা
নিঃসঙ্গ ঘুঘুর হু হু করা খর দুপুরে
নিপাট সময়ে কষ্টের আঁচড়ে শিল্পিত প্রচ্ছদে
পিকাসোর অবিশ্রান্ত আঁকিবুকির মতন।
জ্বলন্ত কষ্টের ঔপনিবেশিক দুঃশাসনে
পর্যুদস্ত জীবনের হাতে সুদৃঢ় চাবুক
তুলে দিতে চাই কোনো এক মাঘী পূর্ণিমার
মসৃণ আলোর নীচে সব কিছু উপেক্ষায় ঠেলে
দিয়ে দূরের দিগন্ত রেখার একান্ত আঙিনায়
বিষাদিত বিভেদের অন্তর্গত অভীক্ষায়।
তীর্থগামী একজন
তীর্থগামী একজন যেনো বলেছিলেন একবার—
কোনো শুদ্ধ মন্ত্র, নাকি তাঁর গুপ্ত রহস্যের কথা
মনে নেই, কিংবা শুনিই নি তখন লোকটিকে ঠিকঠাক।
তবু বোধের ভেতর থেকে প্রায়শই বুদবুদ তোলে
তাঁর উচ্চারণের সুস্থির ঢেউ, জেগে কিংবা ঘুমের গভীরে।
শোকগ্রস্ত তবে আমি?
বাতাসের ভাঁজে ভাঁজে কষ্টের কাহন
চারদিকে কেবলই হারানোর গল্প প্রতিধ্বনি তোলে
ব্যস্ততার সরু ফানেলে খণ্ডিত ভালোবাসা
নির্বিঘ্নে চুঁইয়ে নামে;
একাধারে শীত আর বসন্ত পেরোয়।
স্বপ্নগুলো ঝুরঝুর পড়ে এখানে সেখানে,
প্রতিশ্র“তির গাছতলায় একতারা
বাজায় না চেনা সেই সহাস্য বাউল।
সে ও কি তবে পথভ্রষ্ট হোল?
যূথচারী যন্ত্রণারা প্রবল শাসায়
সর্বংসহা চোখ তবু খুঁজে ফেরে সৌম্যকান্ত সেই পূণ্যাত্নার
শব্দবন্ধ, হয়তো ওরই আচ্ছাদনে পেয়ে যাবো
হারানো রূপোর চাবি গোছা ...
রাত্রিও বিদগ্ধ হয়
রাত্রিও বিদগ্ধ হয় কখনো সখনো।
চাল বেয়ে নেমে আসে শীতের কুয়াশা
ঘুম হয় আরো ঘুমার্ত, ঠাণ্ডায় জড়োসড়ো;
গাছ চুঁয়ে পড়ে শীতল আনন্দ রসের কলসে
বিলম্বিত স্বর্ণালী রোদের অপেক্ষায় এমনকি
নেড়ি কুকুরটিও দুঃখিত হয়
অব্যবহারে মরচে পড়া শব্দবন্ধ নড়েচড়ে
ওঠে মাথার ভিতর
বঞ্চনার খেরোখাতা ভরে ওঠে দ্রুত ব্যস্ততায়
সফোক্লিসও কি এমনি কাতর ছিলেন জীবন সংগ্রামে?
দর্শন কি বিধ্বস্ত সক্রেটিসকে স্বস্তিময় স্বপ্ন
দিতে পেরেছিলো জীবন সকাশে?
অনুতপ্ত গ্যালিলিও আসলে কি দক্ষ অভিনেতা ছিলেন না?
এ কালের মহর্ষিরাও কি একাকী থাকেন ঝুলে
যন্ত্রণার ঝুল বারান্দায় সুনসান?
রাত্রিরও ক্লান্তি আসে,
বিদগ্ধ সময় আবারো একাকী হয়,
আবারো নিঃসঙ্গ পথ পরিক্রম...
নিউইয়র্ক
রাসেল আহমেদ
করাতকল
আমাদের ঘামের নিজস্ব আকুতি আর গাছগুঁড়ির অবিরল উচ্ছ্বাসে পাথর চাপা সময়েও চিড় ধরলো। ভ্রমণের বেশিদিন নেই─তাই সাপলুডু খেলে সময় কাটে আমাদের─আমি দ্বিতীয় দান; তুমিই প্রথম; তোমার সর্পনখা-নাভির জন্মতিল; আমার নখের প্রান্তবিন্দুতে যৌনঘ্রাণ─ যেন বহু আগে সবজি-হরিণ দাঁতে কেটেছিলো সজন্মা ঘাস, আর তখন তার কস্তুরীজল একফোঁটা; আরও নিচে চক্ষু আর আঙুলের জ্যামিতি; আরও নিচে─
করাতকলে একটানা ঘড়রঘড় শব্দ─যান্ত্রিক। পাশেই মালিকের বাড়িতে গোলাপবাগান, মনে পড়ে যায় তুমি ফুল চেয়েছিলে─লালজবা। করাতকল মনে করিয়ে দেয় আমাদের প্রাথমিক দিন─চটিবইয়ের গল্পের চরিত্ররা জীবন্ত হয়ে ওঠে খটখটে রোদে─আমার নতুন বউ; বাথরুমটা খুব নোংরা, হারপিকের একটা খালি বোতল কবে থেকে কাৎ হ'য়ে আছে, একটা ভাঙা ব্রাশ─হাতল নেই, আজ পানি নেই─তাই বড্ড নোংরা, অথচ ওখানেই মনে আসে; মনে আসত ফেনা-ওঠা ভাত আর মিহি কালিজিরা, দোয়েলের রক্ত আর পালক, অদ্ভুত হেঁসেলের ছবি, চায়ের পাতি কিনতে হবে...আজ কী রঙ পরেছো; তিনগাছি চুড়ি পকেটে─ তিনগাছি ভেঙে গেছে, করাতকলে সেই চুড়িভাঙার শব্দ প্রতিফলিত হয়, এবং তখন মনে আসে আমাদের শীৎকার, ভাতের ঘ্রাণের মত যৌনঘ্রাণ, দাঁতেকাটা-ঘাস;─
তোমার চারদিন জ্বর─একশ' তিন─ঘরে প্যারাসিটামল─খেয়েছো কিনা, শুয়ে কাতরাচ্ছো কিনা─পুরনো চিরচেনা করাতকলের মত; তুমি ঘুম কিনা, সর্বত্র লোডশেডিং─পাখাটা ঠিক আছে কিনা, মাথার কাছ থেকে তোষক তুললে হাতপাখা পাবে─জানো কিনা; তালপাতায় আটকে থাকে হাওয়া।
দুপুরের তরকারিটা দারুণ হয়েছে, বাটি চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছি...
এখনও কি কাঁদো শুয়ে শুয়ে, গতকাল বালিশে দাগ ছিল; খেয়ে নিও লক্ষ্ণী; দুপুরে ঘুমিয়েছো কিনা, ঘুমিও; আমায় একটুখানি ভেবো। এখানে বিদ্যুৎ নাই, জেনারেটর, তবু লোডশেডিংয়ে বসে থাকতে হয়, করাতকল চুপ থাকে; লোডশেডিংয়ের পর আবার চালু হয়, আমার আঙুল আর হাত টানে, টেনেই ধরে, টেনেই ধরে─মধ্যরাতে তোমার মত, গভীরে...
ঢাকা
সব্যসাচী হাজরা
ওঠো দেব
হালুম মাতিয়ে তোলে, পা থেকে
মাথা...লাইফ বোটে আমি মাথা থেকে পা।
ঝুঁকি নেবো, কেউ যদি বলে ওঠে, দেব!
থালায় থৈ থৈ রাত, আমিও মদ্য পানে খুশি।
আমিও খুশি একগলা যুবক যুবতীর...
ঘষে নাও শিষ, প্যান্টে ফলেছে থিরথিরে চোখ,
ন্যাওটায় বেগুন, যদিও বীজের কুৎসা;
আমাকেও ধরেছে প্লুটনী, এরপরে শেষ প্লুটো,
উড়ছে বেলুন...
গর্ভ গোনা
শাওয়ার পূর্ণ এ জুলাই মাস,
পরিত্যক্ত চুল্লী─
মোকাম্বো হিমসিম খায় অক্সিজেন যোগাতে...
মইনিহান!
মানবীর সরকার ফেলে দিলো...
তবুও স্থূল মানবেরা
কলারে হত্যার টাই
জমালো ভেজাল...
বারংবার খুঁটি চেপে ধরে
তৃতীয় বিশ্বের পায়ু
ধরিনি লামায়
দর্জির আঙ্গুল ভীরু
গর্ভে কাঁচি ছুঁড়ে দিলে
উমিচাঁদ নাড়িটান
গর্ভ গোনায়
কলকাতা
পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায়
বেশ্যা ও সন্ন্যাসী
যে রোদ্দুর আত্মসচেতনতা মেলে দেয়
ঘুমোতে যাওয়া মেয়েটির নীরব ঊরুর জিজ্ঞাসায়
রুটির মতন খোলা নাভির সান্ত্বনা উপুড় করে─
ডাকবাক্সের মতন উপচে পড়া স্পন্দনহীন রোমশূন্য যোনি ছুটে চলে
বাঁকা-ট্যারা-গলি-রাজপথ খাঁ খাঁ এক অদ্ভুত শূন্যতাকে টপকে
প্রত্নতাত্ত্বিক চুমু খাওয়া দু’চেরা বাতাস এক পদবীতে মিলেমিশে
আঁতাতের সমাজ সভ্যতায় তিন তলার ফ্ল্যাটে আঁতুড়ঘর
এক বাইপ্রোডাক্ট...
পর্দা ফুঁড়ে সন্তর্পণে অস্থির মুখোমুখি দু’জনের
নিউক্লিয়ার ছোট্ট সংসার
কোণঠাসা ভাবনা চিন্তার দুমড়ে মুচড়ে চটকে যাওয়া
রমণ সুখের উষ্ণতা প্রথাগত নিয়ম ব্যাখ্যা চায় না
বিছানার রোজনামচায় ঋতু রক্তের ব্রত কথা মিথ ভেঙে
জন্ম দেয় উদ্দীপনাকে সঙ্গী করে বেশ্যা ও সন্ন্যাসীর!
হাওড়া
নির্মল গোপ
আঁধার
আমার চিন্তা অনুভূতি আর উপলব্ধি
কল্পনা অভিজ্ঞতা আর রঙ ক্যানভাসের রক্তক্ষরণ
নিয়মিত বা অনিয়মিত কামনা লালসামিশ্রিত প্রেম অথবা
প্রেমবর্জিত যৌনচর্চা;
পুষ্পিতরমণ কিংবা যন্ত্রণাক্লিষ্ট পেষণ
গর্ভসঞ্চার বা পরিকল্পিত পরিবারের তাগিদে ভ্রুণহত্যা
নয়তো বা দশম মাসের দশম দিনে প্রভু যীশুর আবির্ভাব
অথবা নিষ্ফলা রক্তপাত
আর
কিন্তু যদি এসব কিছুই না হয়
তবে অবশ্যই বনষ্পতির বন্ধ্যা-তপ্তযোনিতে ফুল ছাড়াই
জারজ কবিতার জন্ম
বলা হয়নি
মিলি, তোমাকে বলা হয়নি যে আমিও সাপ। উষ্ণরক্ত, কালো। পা আছে। কিন্তু তোমার
আমড়ার মত হৃদয় নেই। ওখানে আছে এক নষ্ট ডালিম।
মিলি, তোমাকে বলা হয়নি, বলা হয়নি যে আমিও সাপ। তোমার দেখা কোন সাপ নই।
গোখরো নই। অজগর বা পাইথনও নই। তোমারই মত আমিও এক বাতাস-সাপ।
মিলি, তোমাকে বলা হয়নি যে আমিও তোমার মতই সাপ। আকাশ বিষাক্ত করি তোমারই
মত সমান তালে। পার্থক্য শুধু নষ্ট ডালিম আর আমড়ার।
টাঙ্গাইল
চঞ্চল মাহমুদ
শারীরবিদ্যা
একচিলতে পাহাড়ী বিকেল। উপচে পড়ে জনরোষ।
ঢল নেমে আসে দিগন্তে।
নেহাতই প্রেম, অথচ সংক্রমিত আঙুল।
বৃদ্ধাঙ্গুলি।
কলম চেপে ঘুটঘুটে সন্ধ্যা বরফের আলমিরায় বন্দী।
আরও বন্দী ইউরোপিয়ানদের চোয়াল মাড়ি আর
দু'মাড়ির সবগুলো দাঁত।
বন্দী বিকেলের চৌকাঠ ডিঙিয়ে
কতোখানি রোদ আর কতোখানি আধাঁর
তিন পেগ মগজকে ভিজিয়ে দেয়। অস্থিমজ্জায় লবণের
অস্তিত্বহীনতা।
রক্তের প্রচণ্ড ওঠানামায় শারীরবিদ্যায় প্রবেশ করে বন্দী ব্যাকরণ।
সম্পাদক সমীপেষু
আমাকে কবি বানালে আপনার কী লাভ?
পরের জন্মে ঈশ্বর হতে চাই না।
আবাদী জমির বড্ড অভাব পৃথিবীতে
কবিতায় ফসল হয়, কবিতায় কৃষক বিপ্লবী।
কবিরা কাঁচামরিচ আর লবঙ্গ।
সাইপ্রাস
মোহাম্মদ আতাউর রহমান
ফাগুনের কড়চা
(লেবুভাই স্মরণে)
ফি বছর ফাগুন আসলেই আমরা
সূর্য শপথ নেই, “মৌলবাদ রুখবেই কবিতা।”
কারণ—এ ফাল্গুনেই তোমার সেই
স্বর্গীয় রথ যাত্রার তারিখ; আমরা
উদ্বেলিত হই খুশির আমেজে—
স্মরণিকায় বিজ্ঞাপন ছেপে,
“বেলী চৌধুরী” আর “ম্যান ছেরুমিয়া”র আয়ে
ভাগ বসাতে পারবো নির্দ্বিধায় ।
আমার কবিতা ছাপা হবে, নামটিও
জ্বলজ্বল করবে সোনালি হরফে,
ঘরে ফিরবো শোক সভায় মিথ্যা
ভাষণ শেষে; সাথে মস্ত এক তরমুজ ।
তোমার লাভের ঘরেও রসগোল্লা
পড়বে ঢের, কেননা;
বেঁচে থাকলে
তোমাকে ডেরা খুঁজতে হতো
বেলতলী কিম্বা ধর্মতলার মোড়ে ।
নিউইয়র্ক
ঊর্মিলা চক্রবর্তী
ব্যর্থতা
হঠাৎ কখনো ভোর-স্বপ্নে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাই ছোট্টবেলা
দেখি আকাশ নিজেকে চুবিয়ে নিয়েছে ঘননীল রঙে,
ফুল হাসে চোখে চোখ, বন্ধুতায় কাছে নেয় ঘাস
সাফল্য নরম হাত তুলে আমাকেই যেন ইশারায় ডাকে,
অপেক্ষায় থাকে সমস্ত পৃথিবী
কোনো রাজকন্যা আমি অনায়াসে জিতে নেবো জীবনের বাজি
জেগে উঠি, আদরের ওমটুকু লেগে থাকে গায়ে
মিষ্টি লাগে ভোরের আলতো রোদ
ঘোর ভাঙে, ভাঙে না তবুও
হঠাৎ কাজের মেয়ে কড়া নাড়ে, ঝনঝন বেজে ওঠে
এঁটো বাসনের কাঁড়ি, বাজারের তাগাদায় কর্তার চায়ের দাবি,
নোংরা কাপড়ের স্তূপে বেড়াল ঘুমিয়ে কাদা
ধরতেই হবে আটটার কল্যাণী লোকাল
স্বপ্নের বাগানে ঢোকে হড়হড় কাদাগোলা জল
চটপট ছাড়ি বিছানা, অস্থায়ী টাইপিস্ট
কলকাতা
সোনালি বেগম
বৃষ্টির তোড়
নেপাল-ইউপি সীমানায় লক্ষ্ণীমপুর খিরি জেলায়
শারদা নদীর জলস্তর রেড-পয়েন্ট পার করে
তবাহি করতে ছুটছে। বিখ্যাত দুধওয়া ন্যাশনাল
পার্ক─বিপন্ন অসংখ্য পশুপাখি এবং সংলগ্ন গ্রাম।
দিল্লির রিংরোড বাইপাস এবং মিলেনিয়াম পার্কের
কাছে ট্রাফিক জ্যামে হাঁসফাঁস বৃষ্টির তোড় আর
মোবাইল রিং-টোন ভেসে যায়...
উত্তর প্রদেশ
সুভাষ রবিদাস
স্বাতী নক্ষত্রের জ্ঞান
স্বাতী নক্ষত্রের কাছে রাতের ঝর্ণা রেখে এসেছি
বিবর্ণ প্রজাপতির সাথে কথা বলতে বলতে যখন
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম—গভীর রাতে
আমার ঘুমের ভেতর দিয়ে একটি ধূমকেতু উড়ে গেলো
নামহীন, গোত্রহীন, এক নক্ষত্রকণিকা খসে পড়লো আমার স্বপ্নের মাঝে;
বিদ্যুৎ রেখা টুকরো টুকরো ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশ
না, নভোতল, এক চিরন্তন আকাশের সন্ধানে উড়ে যায়
আমার ঘুমদেবতা, পৃথিবীর বৃক্ষকুল, তৃণকুল
সমাধি ভেবে ছেয়ে ফেলেছে বিছানাতল
কেবল স্বাতী নক্ষত্র জানে সে ঝর্ণায় বয়ে যাওয়া গীতধারায়
ভেসে গেছে আমার কোমল গান্ধার।
মুর্শিদাবাদ
রিজওয়ানুল ইসলাম রুদ্র
নিঃসঙ্গ সমুদ্রের তীরে
সমুদ্রের নিঃসঙ্গ তীর মানে কি এই নিথর পাথরশরীর, ক্রমাগত তীব্র ঢেউ আর যৌনাবেগে ধাবমান নোনাস্রোত...উচ্চকম্পনাংকে চূর্ণ-বিচূর্ণ কাচের উড়োজাহাজ, রক্তাক্ত হাতে নির্জীব ফুলের মৃত্যু! মৃত্যুর মানে কী শুধুই প্রোটোজয়িক দুঃস্বপ্ন? ত্রিমাত্রিক জগতে নিজের নিঃস্ব, রিক্ত, গ্লানিমাখা মুখে শোকের অবদমন। মনে নেই কারও সেই সোনালি রঙিন দুপুর, কিংবা ঘন নীল বিষণœ সেই জোছনা রাত, এক বিশাল ফার বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন অ্যান্ডারসন, খুব কাছেই ঘুরছে সেই দুঃখী লাটিম ও লাল বল...ভালোবেসে এভাবে হারাতে হয়, এভাবে নিঃসঙ্গ হতে হয়? আমিতো নিছক এক হাতভাঙ্গা উদ্ধত টিনের সেপাই, সবকিছু হারিয়েও যে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত! কিংবা বড়দিনের শীতরাতে ম্যাচবাক্স হাতে হিমশরীরে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরী মেয়েটা; মৃত্যুর পরও যে সুন্দর করে হেসেছিলো নিশ্চুপ! এসব স্বপ্নই থেকে যাবে ঘৃণ্য রাজনৈতিক চক্রান্তের আড়ালে, ভিনদেশী চক্রে গর্জে উঠবে পিলখানা, বিডিআর বিদ্রোহ! খুন হবে মানুষ, রাজপথ ভাসবে জনতার রক্তে...
বৃদ্ধ ঈশ্বর নাকি সবাইকে নিয়েই দেখবেন স্বর্গ, তার স্পর্শে কেঁপে উঠবে প্রাচীন বৃদ্ধোন্মাদ মুখ! ...আমার ইচ্ছে নেই ওখানে যাবার, নিঃস্ব পৃথিবীর ছায়াপথে বিশাল অন্তরীক্ষের দিকে তাকিয়ে মৃত প্রেমিকার হাতে হাত রেখে জেগে থাকাতেই সুখ!
অন্তর্ধান
না ফেরার মানে এই নয় যে আর কখনো ফিরবো না!
এতো ঝরানো রক্তের পর, বিমর্ষ আহতের মতো
না ফেরার মানে এই আর কখনো ডুকরে কাঁদবে না
পাথরের ছবিটার দিকে অমলিন তাকিয়ে...
আমাকে ফেরাবে আকাশের চিরন্তন ধ্রুব নক্ষত্র
ঈশ্বরের খুব কাছের মানুষ, মৃতপ্রায় জীবাশ্ম প্রেতাত্মা
যদি না-ও ফিরি, ধর্ষণ, রক্ত আর যুদ্ধের আগমুহূর্তে
প্রিয় মাতৃভূমি
ধরে নিও না ফেরার আরেক অর্থ মৃত্যু!
অস্ট্রেলিয়া
সুবীর সরকার
অঞ্চলগাথা
১
আর ক্রুশকাঠ, শোক ও লজ্জার
ভেসে থাকছে মেঘহীন
রাত
নির্ধারিত ছিলো অনন্ত বিষাদ
সম্পর্কহীনতায় আছি
মরে যাওয়া সম্পর্ক নিয়ে
বেঁচে থাকা
অনুমোদনের পর শান্ত হাসি
দীর্ঘ হাঁটাপথ। পা
কাঁপছে।
২
মেঘের মিনারে বসা চিল
টিপছাপে দাদন তুলছে নিরক্ষর
চাষী
হাস্যকর বনমোরগ
বিকেলের ঘোলাটে
বিক্রয়কেন্দ্র
বাক্যালাপ ঝড় তুলছে
কেমন অচেনা হয়ে ওঠা
কণ্ঠস্বর
গুহামুখে লাল বল
বাজনা শুনছে বাজপাখি।
কুচবিহার
সৈয়দ মোহাম্মদ মাশুক
বুক ভরে নিয়েছি নিশ্বাস
ছিলাম বান্ধব-ছিন্ন আমি গতকাল
বিরুদ্ধ বাতাসে─
পর্যটন নগরী থেকে দূরে সমুদ্র সৈকত ধরে
ক্রমাগত হাঁটতে থাকি─
পেছনে ছায়ার মতো মূর্খ অন্ধকার।
বাতাসের বিরুদ্ধতায় ক্লান্তির রেশ
বেশ ভারি, ভিড় করে ছিলো আমার শরীরে।
যতোটুকু পারি, যতোটুকু ধরে বিপন্ন বিবরে
নিজের নিশ্বাস;
আছড়ে পড়া নোনা জল
কিছুটা করছে সাহসী, সরস।
সমুদ্রই পারে। সমুদ্রই ভুলিয়েছে সব─
হাত উঁচু করে দেখিয়েছে বিশালতা
কতোটুকু ধরে; কতোটুকু গভীরে, গোপনে;
সমুদ্রই জানিয়েছে ছিন্নতার মানে।
বি.দ্র:
সৈয়দ মোহাম্মদ মাশুকের (১৯৩৯-২০১১) মৃত্যুতে শব্দগুচ্ছ গভীর ভাবে শোকাহত। মৃত্যুর মাত্র ক’দিন আগে
এই কবিতাটি তিনি সম্পাদকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
উদয় শংকর দুর্জয়
নিরূপম প্রার্থনা ছিল
অভিবাদন এই মেঘ বৃষ্টি জল ধারায়
এই সমুদ্র স্নান জল কল্লোল এই অসীম নীল
অথই গভীরে নামা শুধু তোমাকে দেবো বলে
কি নিরূপম প্রার্থনা ছিল
মুঠো খুলে দেখি সবটাই ছাই
মেঘেরা দল বেঁধে ফিরে গ্যাছে
তবে কি ডেকে ফিরে গ্যাছে
পড়ে আছে হলুদ পত্রাঞ্জলি
কি অন্ধকার কি মুষল ধারায় ভিজছে অধরা
তোমাকে দেবো তাই
রুমাল খুলে দেখি বিবর্ণ বিষণ্ন পুষ্পাঞ্জলি
তোমাকে দেবো বলে
কি আরাধনাই না করেছিলাম
আকাশ হলো কালো কাক
বৃষ্টি ধুয়ে দিচ্ছে তো দিচ্ছে
কিন্তু অন্তর দেয়ালে লেপ্টে থাকা কাজল
তার কি হবে
পড়ে থাকা অবশ দেহ তবু প্রচেষ্টা নিরন্তর
তবু তোমাকে দেবো বলেই
নিঃশ্বাস এখনও জীবিত।
লন্ডন
|
|