Hassanal Abdullah
[News] [Letters] [Photos][Feedback]
—শামসুর রাহমান —জ্যোতির্ময় দত্ত —আল মাহমুদ —শহীদ কাদরী Back to Front Page |
নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ, হাসানআল আব্দুল্লাহ, প্রকাশক: অনন্যা, প্রকাশকাল: ২০০৭: পৃষ্ঠা: ৩০৪ তৃতীয় সর্গ থেকে১ ক. প্রাচীন বৃক্ষের কাছে নতজানু হই। দু’হাত বাড়িয়ে নেয় নিজের বিবরে। চারিদিকে খেদ, ক্লেদ, যন্ত্রণারা কখনো শিশুর মতো, কখনো বা রুক্ষ, মেজাজী শৃগাল—খেলা করে, ফুঁসে ওঠে—দুরন্ত দুপুরে ছোড়ে নিরন্তর থুথু। আর আমি বৃক্ষের ভেতরে বসে বাড়াই বয়স। গজ ফিতা দিয়ে মাপি হৃদয়ের বেড়। দৈর্ঘ্য প্রস্থ দেখে কখনো অবাক; কখনো আবার কেটে ভাগ করি তাকে। তবুও জড়িয়ে রাখে, শরীরের চারিদিকে লেগে থাকে নিয়মিত অভিজ্ঞতার নিদারুণ দাগ। শব্দ কেটে কেটে কথা বলে। শব্দের বাহুতে চড়ে হুড়মুড়—পড়ে, ওঠে, পড়ে—যখন ছড়ায় তার আবেশী সোহাগ। আমিও বৃক্ষ হই—শাখা প্রশাখায় করি যথাযথ বাতাসের উর্বর আবাদ। খ তবে ওইসব কথা সে আমাকে কখনো বলে না। বলে না সে কবে কোথায়, কখন তার শরীর একদা ভেঙেছিলো। কবে কোথায় কিভাবে সাগর পেরিয়ে জীবনের খানাখন্দ খুলে সবল দাঁড়িয়েছিলো— বলে না সে, কার হাত ধরে একদা এখানে বয়সের জমিন পেরিয়ে উঠে বসেছিলো ট্রেনে বা বিশুদ্ধ বাসে। ঋতুর মতন বদলাতে গিয়ে কবে কখন কোথায় বাকলের ধার ঘেঁষে ফেড়ে চিরে হয়েছিলো একাকার। ২ক যুদ্ধের বিমান আমাদের ঘরে এসে নামে। আতঙ্কিত হই আমরা সবাই। থরথর কাঁপতে কাঁপতে দেয়ালে ঠেকাই মাথা। ঢকঢক পানি গিলি। আর মৃত মানুষের মতো ফ্যালফ্যাল অদূরে তাকাই। মৃত শরীরে দাঁড়িয়ে মৃত স্মৃতির ভেতর খুঁজি অতিরিক্ত সুখের সম্ভার, যদিও তারাও আমাদের মতো করে হাঁসফাঁস। সন্তানের মুখ চেপে স্ত্রীকে দেই কিছুটা সান্ত্বনা। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের ধ্বংস যজ্ঞের মতন উড়ে যায় খাতা, কলম, লেখার পেনসিল, ছেলের খেলনা মেয়েদের লুকানো পুতুল। আসমানী গ্রন্থাবলী উল্টে পড়ে থাকে এখানে সেখানে। পড়ে থাকে কবিতার বই। কী-বোর্ড জানলা দিয়ে উড়ে যেতে যেতে সুদীর্ঘ ‘বিদায়’ লিখে যায় শূন্যতার অসহায় ডালে—একে একে উড়ে যায় সফট্ওয়ারগুলো। খ আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়। আমরা যুদ্ধের বিমানের সাথেই বন্ধুতা করে পাশাপাশি থাকি। মনে হয়, ওরা আমাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই দোলায় পাখনা, শব্দ করে, আর বোমা ফেলে পোড়ায় যতোটা দরকার। ছেলেরাও বিমানের পাখায় বুলিয়ে দেয় হাত, যেনো ওদের একান্ত খেলনা ওগুলো। স্ত্রীও খুশি হন। সভ্যতার আশর্বাদে পড়েন দরুদ। সিলিকন ভেলিতে আমরা প্রতিদিন তৈরী করি লাখ লাখ যুদ্ধের বিমান। ৩ক কিন্তু এসবে কিছুই যায় আসে না আমার কিম্বা আমাদের। পৃথিবীর নিম্নবর্গের পতঙ্গগুলোও হিসেব মতো ঠিকঠাক কাটায় জীবন। কেউ কেউ অবশ্য কখনো মরে। মরে পচে—পচে—পচে থাকে কেউ কেউ হয়তো দাঁড়ায়—কেউ কেউ নিয়মিত পথঘাট চিনে ঘরে ফিরে আসে—সকালে আবার স্যুটটাই পরে আমাদের মতো কাজে যায়। আমরাও মরি, ঘরে ফিরে আসি; সঙ্গমে উন্মত্ত হই, সময় মতন কাজে গিয়ে সিগারেট টানি। রাজনীতি নিয়েও দু’চার কথা বলি। আর বন্ধুদের সুন্দরী স্ত্রী দেখে মনে মনে আফসোস করতে করতে বুড়ো হয়ে যাই। বুড়ো বুড়ো বুড়ো হয়ে যাই। খ বুড়ো হয় আমাদের সন্তানেরা, গৃহপালিত ছাগল আর চার পয়সার কবি, শিল্পী ও তাদের নিয়মিত পিঠচাপড়ানোর জন্যে দু’পা মেলে বসে থাকা অথর্ব, অকেজো সমালোচকেরা। আমাদের শ্রীমতি স্ত্রীরাও অহোরাত্র মুখে পাউডার ঘষতে ঘষতে বুড়ো হয়ে যান; অতঃপর ছেলে মেয়েদের পালা—তাদের সন্তান সন্ততির। তথাপি কখনো বুড়ো হয় না যুদ্ধের বিমানেরা—বর্ধিত দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে শক্তিশালী হয়। ৪ক ওদের ওড়ার গতি ও কার্পেট বোন্বিংয়ের ধরন সুচারু হয় আরো। বিজ্ঞানের ত্রিমুখী আবিস্কারের সাথে সাথে বেড়ে যায় স্কাড মিসাইলের আশ্চর্য গতি—চারিদিক পোড়ানোর বিপুল ক্ষমতা, লক্ষ্যে আঘাত করার অভিন্ন কলাকৌশল। পারমাণবিক বোমার সাথে রাসায়নিক গ্যাসের ব্যবহারেও আমাদের বিজ্ঞানীরা অসম্ভব দক্ষতার ধারাবাহিক প্রমাণ দিতে থাকেন। মূর্খরা অবাক হলেও চিঠির ভেতর বিষাক্ত জীবাণু পাঠিয়ে কখনো কখনো দড়াম করে মেরে ফেলা হয় কিছু কিছু দুর্বল মানুষ। অবশ্য যদিও আমরা মৃত্যুর সাথে অবস্থান করতে করতে ওকে আর ভয় পাই না কিছুতে— নাক, মুখ, চোখসহ ওর পুরোটা চেহারা আমাদের সম্পূর্ণ মুখস্থ হয়ে যায়। খ ধর্মান্ধতার কঠিন অন্ধকার আর তার কর্কশ নির্যাতনও আস্তে আস্তে বাড়ে গতি ও ত্বরণে। অসহায় মানুষেরা পিষ্ট হয় ধর্মের চাকায়—যেনো মধ্যযুগের বর্বর স্রোত; ধর্মই একক পথ জীবনের, বোঝাতেও ছুটে আসে একদার ভয়ার্ত মুখোশ—গণমানুষের স্বাধিকার; রক্ত, ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা আবারো শকুন শেয়াল হায়েনাদের হস্তগত হয়। আর আমরা তখনো অসহায় অসহায় অসহায়ের মতন কবন্ধ তাকিয়ে থাকি। ৫ক বাইরে আলোর পৃথিবীর দিকে জানলার ফাঁক দিয়ে যখন তাকাই মনে হয় এই আলো আমাদের জন্যে অন্ধকারের মতন। বস্তুত আঁধার ও আলোর মাঝে আমরা এখন ব্যবধান খুঁজে পাই না। আমরা যদিও কখনো ওইসব নিয়ে অতোটা ভাবিনা, আমরা যদিও দুই বেলা নরম খাবার আর মাঝ রাতে সঙ্গম আক্রান্ত হয়ে সুখে আছি বলে ঢেকুর তুলতে থাকি, অতিক্রান্ত সময় তথাপি আমাদের চারপাশে অন্ধকার বুনে যায়। পিছনের দিকে তাকানোর সামান্য সময় পেলেও দেখতে পাই না কিছুই। সামনের দিকে হাঁটি কিন্তু আস্তে আস্তে নিজেদের অজান্তেই ঢুকে যাই বিরুদ্ধ বয়সে। খ তরঙ্গায়িত সন্ধ্যার কাছে নিজেদের ছেড়ে দিই। ছেড়ে দিই আহ্লাদিত সভ্যতার কাছে; আর দুই হাতে যারা তুলে নিয়েছিলো আমাদের সুখ ও দুঃখের সরল সমীকরণ। আমাদের ত্রাতা হয়ে উঠেছিলো যারা—সেই সব ভগবান, অথচ কুকুর ভিন্ন অন্য কিছুই হবার যোগ্যতা ছিলো না—এখন অক্লেশে আমাদের মস্তিষ্কের মখমলে খাটে বসে তারাই বানায় ক্লান্তিসিক্ত নায়ের বাদাম। ৬ক শীতনিদ্রা থেকে জেগে উঠে পাথর যখন ধীরে ধীরে চোখ খোলে— দোতলার সিঁড়ির ফোকর দিয়ে আসা সূর্যের ভয়ার্ত আলো আরো বেশী ভয়াবহ মনে হয়। মৃত্যুপুরীর মতন লাগে তার চারপাশের উলঙ্গ পৃথিবীকে। আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে থাকে ভাড়াটে ঘরের আসবাবপত্রগুলো। আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয় বিছানা বালিশ, বাঁশের পাতার মতো রান্নাঘরের ঝুলন্ত দরজার পর্দা। মেঝেতে অবশ পড়ে থাকা টিভির রিমোট, ছয়মাস আগের প্লাষ্টিক ব্যাগ আর ভিসিয়ারের উপর অসংখ্য ধুলোর আস্তরণ। পেটে ক্ষুধা অনুভূত হতেই দেখতে পায় পাশে শোয়া ফুটফুটে শিশুটিকে—নিজ জরায়ুর রক্তে ভেজা। খ আস্তে আস্তে মনে পড়ে ঘুমঘোর জীবনের অনেকটা অকেজো সময়। আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয় শিশুর ক্ষুধার্ত চিৎকার। আস্তে আস্তে জেগে ওঠে মাতৃত্বের প্রকৃতি প্রদত্ত বোধ। ক্লান্ত ত্বক থেকে নেমে আসা ঘনায়মান শূন্যতা ঝেড়ে ফেলে উঠে বসে। কোলে তুলে নেয় ঘরের অতিথি—একমাত্র শিশু। সদ্যজাত নতুন মানুষ। স্তনে মুখ দিয়ে সকালের গোলাপের মতন নীরব হয়ে যায় 'নতুন' নামের এই অসময়ের একান্ত সহচর। ১০ক গাড়ি বারান্দায় নক করতেই দেখি তুমি—আমাকে জড়িয়ে নিলে আষ্টেপৃষ্ঠে। আমি ভালো ভাবে এই প্রথম তোমার দিকে তাকালাম; ভাবলাম তুমি বুঝি শেক্সপীয়রের ওফেলিয়া। লরা বা নোরার মতো তোমার মুখাবয়ব কিনা খুঁটিয়ে দেখলাম। মহুয়া মলুয়া বনলতা সিন্ডারেলা, মোনালিসা কিসে তোমাকে মানায় বেশী জানতে চাওয়ার আগেই তুমি বরফের মতন মিলিয়ে গেলে নিমেষে; নীরব নির্দ্বিধায়। খ মাঝে মাঝে, এইভাবে, ভাবালুতা পেয়ে বসে—মাঝে মাঝে এই ভাবে মনে হয় তুমি আছো। তুমি আছো নক্ষত্রে, পাথরে। আমার ভেতরে। তুমি আছো, মনে হয়, চারপাশে ছায়া ছায়াহীন সৌন্দর্যের মতো... তোমার শরীরে হাত রাখতেই অসীম পুলক জেগে ওঠে— তোমার দেহের মধ্যে নিভন্ত আগুন...যখন প্রবল শীতে জড়োসড়ো আমাকে উত্তাপে কর্মক্ষম করে তোলা। তোমার পর্দায় হাত রেখে মনে হয় 'অনাদি কালের যতো চাওয়া যতো পাওয়া' এখানে লুকিয়ে ছিলো এতোদিন। আমি সীমাহীন পূর্ণতায় এগিয়েই যেতে থাকি...সাগর পাহাড় বেলাভূমি আর প্রকৃতির নিয়মিত বাধা আমাকে কিছুতে আটকাতে পারে না। এগিয়ে যাই তোমার অসীম আরশের ছায়া-জলে...তারপর কিছুক্ষণ নীরব নিস্তেজ পড়ে থাকি। তুমি আছো তাই জেগে উঠি আবারও। ১১ক সন্ত্রাস কমাতে নামে আরেক সন্ত্রাস। হাত বেঁধে, চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। লাথির ভাষায় ঝরে রক্ত—চারিদিকে রক্তের প্লাবন...অতঃপর মৃতদেহগুলো টেনে নিয়ে চলে যায় পায়ে দড়ি দিয়ে নিজস্ব ভাগাড়ে। আসে বন্দুকের নল আর শক্ত বুটের পাদুকা...কথা বলা এখানে নিষেধ— নিঃশ্বাসও। জলবন্দী মানুষের মতো সেনাবন্দী অসহায় কাতর মানুষ... সন্ত্রাস কমাতে নামে, পৃথিবীতে, সন্ত্রাসের দীর্ঘ মহামারী... খ যক্ষ্মা টিউবারক্লোসিস ও এইডস...বুদ্ধি-বিবেচনার কিনার ঘেঁষে গন্ধময় পুঁজ, বড়ো বড়ো ফোঁড়া; নেমে আসে রক্ত-বমির সফল ধারাবাহিকতা। ঋতুস্রাবে গলগল বেয়ে আসা সীমাহীন বর্জ্য। আর খাকি ট্রাকের বিশাল আলখাল্লা পরা পূর্ণায়মান বিরুদ্ধ চাকা। কৃষকের হাল ঢোকে, কৃষাণীর বিভ্রান্ত চুলের মুঠি...ছাত্রের কাগজপত্র, শিক্ষকের বুক... পথচারীর চপ্পল আর গৃহহীনের অবশ অবশিষ্ট হাড়গোড়। বুদ্ধিজীবীদের মেধা ও মনন নিয়ে খেলা করে জলপাই সমাবেশ। সন্ত্রাস কমাতে নামে, পৃথিবীতে, ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। শিশুদের কান্না ধ্বনি থেকে শুরু করে মধ্যরাতে সঙ্গমও পুরোপুরি নিষিদ্ধ এখানে। ১৫ক ক্লান্তিকর এইসব দিন। ছিন্নভিন্ন মলিন কাঁথার মতন আশা পড়ে থাকে বিছানা বালিশে, ঘর দোর বারান্দায়, জীবনের আশেপাশে— কখনো বা মেচি কুকুরের মতো হাত-পা ছড়িয়ে অচেনা রাস্তায়। নিয়তির নিয়মিত অন্ধকার কেটে ভোর হয়—কিন্তু আমাদের জীবনের বিপুল আঁধার ঘোর অমাবস্যার মতন চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছড়িয়ে সতত সঞ্চরমান—বিষণ্ন বিবশ। খ ছারপোকাদের মতো আমাদের বেঁচে থাকা। গণ্ডায় গণ্ডায় সন্তান উৎপাদন আর হাহুতাশে দিক-বলয় ফাটিয়ে কারো কারো দু’আঙ্গুলের ভেতরে মরে থাকা—উপরন্তু সামান্য দুর্গন্ধ ছড়ানোর অন্তিম কৌশল। তেলাপোকাদের মতো আমরা নিয়ত বেড়ে যাই বিপুল সন্তান সন্ততির ঝাঁক সাথে নিয়ে—পায়ের তলায় অতঃপর পড়ে মরে থাকি। আমাদের অকাল মৃত্যুতে স্ত্রী-পুত্ররা দু’দিনের ঘরোয়া শোকোৎসব শেষে নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে; বাকি পৃথিবীর কিছুই তখন যায় আসে না। আবার কারো কারো ভাগ্যে ইন্নালিল্লাহে অইন্না রাজিউন ছাড়া কিছুই জোটে না। ১৬ক মানুষকে দ্বিখণ্ডিত করেছে মানুষ। মানুষকে ত্রিখণ্ডও করেছে মানুষ। ...চার পাঁচ ছয়...সহস্র...অপার। ভাগ ভাগ করে তারা নিয়মিত চালিয়েছে তাদের শাসন; কোদাল, খড়গগুলো উঁচু করে ধরে রেখে মাথার উপর; ধর্মীয় নির্মম মিথ্যাচার মানুষকে দাঁড় করে দিয়েছিলো নিদারুণ ভয় ও লোভের পাশাপাশি—গোত্রে, বর্ণে-ধর্মে আলাদা করেছে স্ববর্ণিত প্রেরিত পুরুষ। আর স্বজাতির সান্ত্বনায় লিখে রাখা ওইসব কথিত কিতাব। খ আমরা ছিলাম মূর্খ; কিছুই বুঝিনি। ভয়ে শুধু পিছু পিছু হেঁটেছি তাদের। ব্রজবুলি, তাদের কথাকে ভেবে মুক্তির শপথ—বুঁদ হয়ে থেকে গেছি তাদের ডেরায়—উবু হয়ে, নত হয়ে কপালও ঠেকিয়ে দিয়েছি ওইসব স্বকথিত নবীদের পায়ের তলায়—প্রতিদিন নতুন আয়াত দিয়ে তারা সান্ত্বনা দিয়েছে। নতুন শপথ পড়ে আমাদের বলেছে, "এবার যাও। যতো দূরে পারো, গড় তোমাদের ঘর। দূর-দূরান্ত থেকেই পাবে অধিক সোয়াব।" পুণ্যলোভী আমরা মানুষ—কখনো দারুণ ভীত—গোত্র ছেড়ে চলে গেছি বহু বহু দূরে—নতুন নতুন গোত্র গড়ে তুলেছি আমরা বহুবহু গেরামের ’পর— অতঃপর রক্ত নিয়ে খেলেছি সৌখিন—সৃষ্টি ও সম্পদ গেছে বেড়ে। ১৯ক বিলুপ্তির পথে হামাগুড়ি দেবে এই বিশ্বাসে অটল তোমাদের প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে নিজেই নিজের চলার ও কথা বলার সহজ পথ করে নিয়েছি আমিও। "অতএব তুমি বানরের বংশধর? বানর থেকে কী তুমি এভাবে রক্তে ও মাংসে পূর্ণতা পেয়েছো!" বলেছো একযোগে তোমরা, যদিও তোমাদের চোখগুলো তখন অগ্নিশিখার মতো জ্বলজ্বল করেছে; দু’হাতে খোন্তা ও কোদাল—ভয় দেখিয়েছো খ কবরের। আমি সাদা কালো বিভিন্ন রকম মানুষের বিভিন্ন মুখাবয়ব দেখিয়ে বলেছি, "শুধু বানরই নয়, সম্ভবত ভিন্নভিন্ন প্রজাতির থেকে তুমি আমি আমরা সবাই আস্তে আস্তে মানুষের রূপ পেয়েছি।" বলেছি, "ওই সব গ্রন্থ তোমাদের যা কিছু বলেছে সবই ব্যক্তি ও কিছু সংখ্যক মানুষের বাধানো বাহাস। তারা ভেবেছিলো অশিক্ষা যেভাবে গোত্রে গোত্রে বাসা বেধেছে, যেভাবে চারিদিকে মানুষের অধঃপতন ঘটেছে, তাতে ভয় ও লোভের মাধ্যমে ওদের পথে আনা যাবে। সফল হয়েছে কেউ কেউ।" কিন্তু সত্যকে জানার জন্যে তোমাদের দৃষ্টি দূরে নিক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছি। যদিও আমাকে তখন আষ্টেপৃষ্ঠে তোমরা বেঁধেছো। গ্যালিলিওকে বলেছো, "বল শুয়োর আমি যা বলেছি সবই ভূল।" তারপর তোমাদের অস্ত্রগুলো সচল হয়েছে...হচ্ছে প্রতিদিন। ২২ক তোমাদের সাথে কথা বলার ইচ্ছাও মাথা চাড়া দেয়—উঠে আসি— দরজা খুলেই দেখি তোমরা দুদ্দাড় যাচ্ছো চলে, দোতলার সিঁড়ি বেয়ে...আমাদের বাগানের গাছগুলো তোমাদের শাড়ি ধরে টানাটানি করে। আমাদের ফুলের টবেরা তোমাদের রূপের বর্ণনা করতে করতে আড়চোখে সূর্য দেখে নেয়...তোমরা চলার গতি বাড়িয়ে দিতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে ফুলগুলো। খ তোমাদের ব্রেনগুলো ভিজে ভিজে পুরোনো কাপড়ে মোড়া ন্যাপথলিনের মতো অনেকটাই নিঃশেষিত হয়ে গেছে... তোমরা এখন ভালো ও মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারো না। তোমরা স্টেডিয়ামের আকৃতি দেখেও ভয় পাও; মনে করো বোমা বানাবার কারখানা। চিনতে পারো না জ্বীন-তত্ত্বের গভীরে এঁকে দেয়া মা ও বাবার সম্মিলিত সঞ্চালন। অতএব মিসাইলগুলো দ্বিধাহীন আঘাত হানতে থাকে বন্দরে বন্দরে, ছেলে বুড়ো ও পোয়াতি মেয়েদের বসবাসরত ঘর ও দালানে; বিদ্যালয়গুলো ধুলো হয়। কিন্তু যুক্তিতর্কের কাছেও যাবে না তোমরা, তাও জানি। ২৩ক আমি ও পাথর হাঁটি পোড়া পোড়া জমিনের পর। পোড়া ঘর পোড়া বাড়ি, পোড়া গৃহে সমস্ত অক্ষর—ঘরে ঘরে দাউ দাউ জ্বলছে আগুন লেলিহান; আমাদের মন পোড়ে, হৃদয়ও পুড়ে খানখান। আমাদের চোখ পোড়ে, পোড়ে লিঙ্গ—নাখ মুখ দু’হাতের দশটা আঙ্গুল। পুড়ছে বাসনাগুলো, বিছানার তাবদ উল্লাস। চারিদিকে শুয়ে আছে মানুষের পোড়া পোড়া লাশ; কুকুর বিড়াল সহ বনে বনে যতো ছিলো পাখি; যতো ছিলো সুখে ও অসুখে নিয়মিত তাদের সম্ভ্রান্ত ডাকাডাকি। পাতার মর্মর ধ্বনি, পুড়ে গেছে কবিতার খাতা—আমি ও পাথর হাঁটি, সূর্য পোড়া আমাদের ছবি। খ বিছানা উত্তপ্ত মাটি, সেখানেই শুয়েছে পাথর। উলঙ্গ আমিও শেষে সঙ্গমে আকুল...মাঝে মাঝে দমকা বাতাস, গন্ধ আসে পোড়া পোড়া ছাই...পাথরের মুখ চুষে, বুক চুষে নিজেকে বাঁচাই। এভাবে উভয়ে বাঁচি পোড়া এই জমিনের পর; পুরোটা পৃথিবী যেনো আমাদের নিজেদের ঘর; পুরোটা পৃথিবী জুড়ে নক্ষত্র সাজায় তার নিজস্ব পতাকা...পোড়ে তা-ও অসময়ে সাবলীল দ্বিধার আগুনে। |
—Nicholas Birns amazon.com: Reviews, 2008 |