|
বাবার কাছে চিঠি
মৌলি আজাদ/Mouli Azad
দেখতে দেখতে তিনটি বছর কেটে গেলো বাবা, তোমাকে দেখিনা আমি। আমি আসলে বুঝতে পারছি না তিন বছর কি খুব
বেশি সময়, নাকি কম? যখন খুব একা থাকি তখন মনে হয় তি...ন বছর ধরে তোমাকে দেখিনা, আবার পরক্ষণেই
ভাবি আরে এইতো সেদিন তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে। আসলে কি জানো, তোমাকে নিয়ে ভাবতে বসলে আমার মাথা
একদম কাজ করেনা। ইদানিং মাথাটা মনে হয় কেমন যেনো ভোঁতা হয়ে গেছে।
আমার বুকের মধ্যে সারাক্ষণ হুহু শব্দ হতে থাকে। বাবা, আগে কখনো বুঝিনি বুকের মধ্যে হুহু করা কি জিনিস।
শুধু গল্প উপন্যাসেই পড়তাম। কিন্তু আজ বুঝি। মনে হয়, এই শব্দটা যারা অকালে প্রিয়জনদের হারায় তাদেরই জন্য।
আসলে তোমার জন্য আমার এ এক অব্যক্ত কান্না, যা দেখা যায় না, শুধু বুকের ভেতরটা কিছুক্ষণ পরপর দুমড়ে মুচড়ে দেয়।
আরো বেশি কষ্ট লাগে যখন তোমার স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে। এ যেনো এক পুরোনো ফিল্ম, যা অনবরত দৃষ্টিতে প্রসারিত।
খাবার রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হয় ওইতো তুমি খালি গায়ে হেঁটে যাচ্ছো তোমার পড়ার রুমের দিকে।
মাঝ পথে তোমার সঙ্গে আমার দেখা। চোখে চোখ পড়তেই তুমি বলছো, ‘চা বানাত এককাপ।’ কিম্বা তুমি নিজেই রান্নাঘরে
যাচ্ছো চা বানাতে। খাবার টেবিলে বসতেই মনটা খচখচ করে ওঠে। মনে হয় তুমিও যেনো আমাদের সঙ্গে বসে খাচ্ছো।
আর তোমার পড়ার রুম। সেখানে গিয়েতো বসাই যায় না। চোখ ফেটে বেরিয়ে আসে জল। চারপাশে তোমার নিজের লেখা
বইগুলো যেনো রীতিমত আমাকে আক্রমন করে। টেবিলে পড়ে থাকা বইগুলোকে মাঝে মধ্যে খুব বেশি অসহায় মনে হয়,
ঠিক যেমন ২৭শে ফেব্রুয়ারীতে আক্রান্ত হওয়ার সময় তোমার মুখখানা। তোমার কম্পিউটার ও টেলিফোনটি কেমন যেনো
ঝিম মেরে বসে আছে। তারাও যেনো আজ তোমারই মতো কর্মহীন ও নির্ঞ্ঝাট। তোমার পড়ার ঘরের ডানদিকে তাকালেই
দেখি তোমার বসার সোফাটি। মনে হয় ওইতো তুমি হাঁটু মুড়ে ওইখানে বসে আছো্। ওঘর থেকে যেই না বের হয়ে দরজা
লাগাবো, ওমনি যেনো শুনি কম্পিউটারের খটখট শব্দ। উফ্, সত্যিই আমার মাথাটা গেছে। তোমার পড়ার ঘরটাকে বেশ
গরমই মনে হয়; জানিনা এখানে কিভাবে লিখতে তুমি। এনিয়ে কখনো অনুযোগ শুনিনি তোমার। অবশ্য দেশের খারাপ
অবস্থার জন্যে ছাড়া আর কোনও অনুযো্গই তোমার ছিলো না। আর তার জন্যেই তোমার শেষ পর্যন্ত দিতে হলো প্রাণ।
চলে আসি তোমার শোবার রুমে। চোখ পড়ে তোমর সিগারেটের এ্যাশট্রের দিকে। তোমার শেষ খেয়ে
যাওয়া কয়েকটি সিগারেটের খোসা এখনো আছে তাতে। বড়ো মায়া লাগে। ঘর থেকে তাই বের হই কিছুক্ষণ তোমাকে ভুলে
থাকবো বলে। কিন্তু তা কি আর পারা সম্ভব! এখনো ইউনিভার্সিটির দেয়ালগুলোতে তোমাকে নিয়ে লেখা চিকাগুলো রয়ে গেছে।
তুমি চলে যাবার পর থেকে কলাভবনে যাইনা একেবারেই। কারণ ওখানে গেলে কষ্টটা যেনো আমার দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আর
বাঙলা একাডেমীর রাস্তার পাশ দিয়ে পারত পক্ষে যাই না। ওখান দিয়ে গেলে কষ্ট নয় তোমার রক্তাক্ত মুখের কথা মনে পড়ে
যায় আর আমার শরীর ভয়ে সিটিয়ে ওঠে। তোমার মতোই বইমেলার কথা শুনলে না গিয়ে পারিনা। কিন্তু আগামী প্রকাশনীর
স্টলের সামনে যাওয়া মাত্র আমার যেনো আবার কি হয়ে যায়। মনে হয়, ওইতো তুমি জিন্সের শার্ট প্যান্ট পরে দিচ্ছো অটোগ্রাফ,
কোনো তরুণী ভক্তের সাথে করছো রসিকতা। আর দাঁড়াতে পারিনা সেখানে। সোজা বাস ধরে চলে আসি তোমার সবচেয়ে প্রিয়
রাড়িখাল গ্রামে। তোমার প্রিয় গ্রামের প্রিয় বাড়ির সামনেই তুমি শুয়ে আছো। চারপাশে খাঁ খাঁ রোদ্দুর। সামনের পুকুর ভরা কচুরিপানা।
হঠাৎই দেখি তোমার কিছু ভক্ত ধীর পায়ে তোমার জন্মদিনে তোমারই কবরে নিয়ে যায় কচুরি ফুলের মালা। তুমি বুঝতে পারো কিনা
জানি না। হয়তো এ সবে তোমার এখন আর কিছু আসে যায় না। নাকি তুমিও এ সব এখন বোঝো? জানি না।
আর এভাবে বাবা তোমার ৬০তম জন্মদিনে তোমাকে শ্রদ্ধা জানাই।
|